দেশের শিল্পাঞ্চল গুলোতে একের পর এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড এখন যেন নিয়মিত দৃশ্য। প্রতিদিন সংবাদপত্রের শিরোনামে একই ধরনের খবর- গুদামে আগুন, পোশাক কারখানায় আগুন কিংবা এবার সরাসরি ঢাকায় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন! প্রশ্ন উঠছে, এসব কি নিছকই দুর্ঘটনা, নাকি পরিকল্পিত অন্তর্ঘাত? আমাদের শিল্প নিরাপত্তাব্যবস্থায় দীর্ঘদিনের অবহেলা, দুর্নীতি ও দায়িত্বহীনতা যেন এখন কাঠামোগত রূপ নিয়েছে। নিরাপত্তা মানদণ্ডের অভাব, অপ্রশিক্ষিত শ্রমিক, দুর্বল অবকাঠামো এবং নিয়মনীতি উপেক্ষা- সব মিলিয়ে এক ভয়ংকর বাস্তবতা গড়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে একটি স্ফুলিঙ্গই যথেষ্ট পুরো এলাকা পুড়িয়ে দিতে। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে দেশের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ভয়াবহ আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে- যা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক ও অস্বাভাবিক।
চলতি মাসের ১৪ অক্টোবর ঢাকার মিরপুরের শিয়ালবাড়ি এলাকায় রূপনগর শিল্পাঞ্চলের একটি পোশাক কারখানা ও রাসায়নিক গুদামে ভয়াবহ আগুন লাগে, যেখানে কমপক্ষে ১৬ জন নিহত এবং ৮ জন দগ্ধ হন। ১৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (সিইপিজেড) একটি কারখানায় আগুন লাগে; ফায়ার সার্ভিসের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে লেগেছে প্রায় সাড়ে ১৭ ঘণ্টা। এরপর ১৮ অক্টোবর বেলা ২টা ১৫ মিনিটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে শুরু হয় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, যা রাত ৯টা ১৮ মিনিটে- প্রায় সাড়ে সাত ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুন লাগার পর বিমানবন্দরের সব ফ্লাইট সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়, যা রাত ৯টার পর পুনরায় চালু হয়। এই ঘটনাগুলোর ধারাবাহিকতা কোনোভাবেই সাধারণ হিসেবে দেখা যায় না। মাত্র চার-পাঁচ দিনের মধ্যে তিনটি বড় অগ্নিকাণ্ড, তা-ও দেশের তিনটি কৌশলগত স্থানে- এটি নিঃসন্দেহে গভীর উদ্বেগের বিষয়। বিমানবন্দর কার্গো ভিলেজের আগুন লাগার ঘটনাটি অনেকেই প্রত্যক্ষ করেছেন। শনিবার বেলা ২টা ১৫ মিনিটে আগুন লাগে। এরপর বিকাল ৫টার দিকেও সামান্য ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে। মনে হয়েছিল আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হবেন কিন্তু ঘণ্টাখানেক পর দেখা গেল ভয়াবহ আগুন, যার মাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এত দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়া এবং দমনে দীর্ঘ সময় লাগা- সব মিলিয়ে একধরনের পরিকল্পিত অন্তর্ঘাতের আশঙ্কা অস্বীকার করা যায় না। ৬ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম এক বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটবে।’ তার এই বক্তব্যের পরপরই দেশজুড়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ আইনগত ও রাজনৈতিক ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে রয়েছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরা, জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর, সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তা এবং শেখ হাসিনাসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে বিচারপ্রক্রিয়ায় নতুন মোড়; দেশি এবং পার্শ্ববর্তী একটি শক্তিধর দেশের প্রকাশ্য অসন্তোষ। এই প্রেক্ষাপটে পরপর তিনটি অগ্নিকাণ্ডের সময়কাল সন্দেহজনকভাবে ঘনিষ্ঠ, যা ঘটনাগুলোকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে। এখন প্রয়োজন প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা। আগুনের সূত্রপাতের ধরন, দাহ্য উপকরণের অবস্থান, নিরাপত্তা অ্যালার্ম ও স্প্রিঙ্কলার সিস্টেমের কার্যকারিতা এবং নিয়ন্ত্রণে বিলম্বের কারণ- এসব দিক গভীরভাবে যাচাই করতে হবে। সরকার, শিল্প মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর যৌথ উদ্যোগে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিশন গঠন জরুরি, যাতে আগুন লাগার পেছনে কোনো অন্তর্ঘাত বা নাশকতা ছিল কি না, তা স্পষ্ট হয়।
পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে- তাই এখনই প্রয়োজন নাগরিক সতর্কতা, শিল্পাঞ্চলগুলোতে নিরাপত্তা অডিট এবং জরুরি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার আপডেট। দোষীদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনি প্রক্রিয়ায় না আনা গেলে এ ধরনের ঘটনা আরও বাড়তে পারে, যার পরিণতি হবে ভয়াবহ। অগ্নিকাণ্ডের এই ধারাবাহিকতা নিছক দুর্ঘটনা নয়, এটি দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থার এক বড় সতর্কবার্তা। আমাদের শিল্প, অবকাঠামো ও প্রশাসনিক কাঠামোর ভিতরের দুর্বলতাগুলো এখনই চিহ্নিত না করলে, আগুন শুধু ভবন নয়, জাতির ভবিষ্যৎকেও গ্রাস করতে পারে। জনগণ এখন একটাই প্রশ্নের উত্তর জানতে চায়, এই আগুনগুলো কি কেবল দুর্ঘটনা, নাকি পরিকল্পিত অন্তর্ঘাত?
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, আহ্বায়ক, আমরা বিএনপি পরিবার ও সদস্য, বিএনপি মিডিয়া সেল