সালাহ্উদ্দীন আহমদ দি বেস্ট। এমন অভিধা তাঁর পাঠদানের (রাবি, জাবি ও ঢাবির) বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, সজ্জন, সহকর্মী ও শিক্ষার্থীমানসে ছিল সদা প্রোথিত। এমনই এক নির্ঝঞ্ঝাট নির্মোহ ভালোমানুষ ছিলেন তিনি। দুবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং একবার বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান হওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েও সবিনয়ে তা ফিরিয়ে দিয়ে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন ক্ষমতা আর অবস্থানের মোহ তাঁর নেই। বরং একজন শিক্ষক হিসেবেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, আর শিক্ষক হিসেবে নিজেকে মেলে ধরাতেই তাঁর রয়েছে কিছুটা আত্মতুষ্টি, আত্মপ্রসাদ! একজন সত্যিকার আলোকিত মানুষ কতটা আপন ঔজ্জ্বল্যে ভাস্বর থাকতে পারেন মুক্ত মানুষদের পছন্দের ও শ্রদ্ধার ব্যক্তি হয়ে, তার বাস্তব নিদর্শন তো অনেকেই দেখেছেন সালাহ্উদ্দীন স্যারকে নিয়ে। প্রসঙ্গান্তরে তাঁর নাম উঠলে, আলোচনার বিষয় হলে, একবাক্যে সবাই তর্কাতীতভাবে তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যেতেন। হ্যাঁ, শিক্ষাবিদ সালাহ্উদ্দীন আহমদ এমনই এক সমীহজাগা নাম। এমনই এক মানবিক, শুদ্ধ জীবনবোধের প্রতীকপুরুষ। যিনি পরলোকগত হয়েও আছেন মননশীল ও মানবীয় ভাবনা বিস্তারের জাগ্রত বিবেক হয়ে। ব্যক্তিমানুষের বাইরেও একজন ইতিহাসবিদ হিসেবে তিনি কতটা স্বীকৃত ও মান্য, সেটা তাঁর সময়ের ইতিহাসবিদদের থেকেই জেনে নেওয়া ভালো। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন তাঁকে নিয়ে যেমনটি লিখেছেন, ‘অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদের ইতিহাসবিষয়ক কর্মে প্রতিফলিত তাঁর গবেষণা-প্রাসঙ্গিক কলাকৌশল আর প্রজ্ঞা-সজ্ঞা উৎসারিত মনন। উপরন্তু তাঁর বিস্তর ও বিবিধ কর্মে আছে স্বদেশ-স্বসমাজলগ্ন প্রণোদনার স্বাক্ষর। ফলে অধ্যাপক আহমদ গতানুগতিক ইতিহাসের কারিগর থেকে উন্নীত হয়েছেন ইতিহাসবিদ হিসেবে।... তাঁর ইতিহাসচর্চার মধ্যে উৎকীর্ণ একাধারে সর্বজনীনতা ও বিজ্ঞানমনস্কতা। ...তিনি বাংলার ইতিহাসের মানবিক, উদারবাদী ও অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য যে পরিমাণ পাঠকের সামনে হাজির করেছেন তা এক দৃষ্টান্ত।’
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তাঁর এই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সম্পর্কে লিখেছেন, ‘শেণীকরণ করলে অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদকে সামাজিক ঐতিহাসিকই বলতে হবে। সামাজিক ঐতিহাসিক হিসেবে তাঁর খ্যাতির ভিত্তি পরবর্তী গ্রন্থসমূহ নয়, বরং সোশ্যাল আইডিয়াজ অ্যান্ড স্যোশাল চেঞ্জ ইন বেঙ্গল (১৮১৮-১৮৩৫) এই প্রথম গ্রন্থটি। ১৯৬৫ সালে লাইডেন থেকে বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর ঐতিহাসিক হিসেবে দেশবিদেশে তিনি যে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তার রেশ এখনো মুছে যায়নি।’ দুজনের উপরিউক্ত মূল্যায়ন থেকে সহজেই অনুমেয় সালাহ্উদ্দীন আহমদের ইতিহাসনিষ্ঠ ভাবনা, গবেষণা কী?
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের উপাদান সংরক্ষণে সাধারণ মানুষের যে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, সে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অংশগ্রহণকে তাদেরই বিবরণে তুলে ধরার জন্য তিনি উদ্যোগী হয়ে তাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করেছিলেন। যার ফলে প্রকাশিত ‘কথ্য ইতিহাসের রূপরেখা’ এবং ‘কসবায় মুক্তিযুদ্ধ’। এর অর্থায়ন করেছে ফোর্ড ফাউন্ডেশন। নব্বইয়ের দশকে সালাহ্উদ্দীন আহমদ এ কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
সালাহ্উদ্দীন আহমদ তাঁর নির্বাচিত প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘ইতিহাস ঐতিহ্য জাতীয়তাবাদ গণতন্ত্র : বাংলাদেশে জাতীয় চেতনার ‘উন্মেষ’ শীর্ষক লেখায় লিখেছেন,
‘জাতীয়তাবাদ যেহেতু একটি ভূভিত্তিক চেতনা, এর একটি প্রধান উৎস হলো ভূখন্ডের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা; সেই সঙ্গে এসে যায় সেই ভূখন্ড বা দেশে বসবাসকারী ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব শ্রেণির জনগণের মধ্যে একাত্মবোধ বা সহমর্মিতা। সুতরাং জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।’ লক্ষণীয় ইতিহাসবিদ আহমদ তাঁর প্রায় লেখায় জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদের বিষয়টিকে সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি নিজে একজন অসাম্প্রদায়িক আদর্শ মানবতন্ত্রী ছিলেন বলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদারনৈতিক পরধর্মসহিষ্ণু ধারা ও বৈশিষ্ট্যকে সমর্থন করেছেন। তিনি মনে করতেন, বৈচিত্র্যের মধ্যেই ঐক্য এবং শান্তি। রামমোহন রায়কে তিনি মনে করতেন ভারতের আধুনিক জাতীয়তাবাদের প্রথম প্রবক্তা। তাঁর সমন্বয়ধর্মী চিন্তাধারার প্রভাব নিজের ব্যক্তিগত জীবনের ওপরও পড়েছে বলে তিনি স্বীকার করেছেন। আমরা তার প্রমাণও দেখেছি তাঁর চিন্তাভাবনার ভিতরে। বস্তুত দুজন মহান মানুষ দ্বারা তিনি ভীষণ প্রভাবিত হয়েছেন- তার একজন রামমোহন ও অন্যজন মানবেন্দ্র নাথ রায়। আর এই দুজনের আদর্শ ধারণ করেই তিনি আমৃত্যু চলতে চেষ্টা করেছেন। সালাহ্উদ্দীন আহমদ ছিলেন একজন নিখাদ বাঙালি ও একজন নিখুঁত মানবতাবাদী। তাঁর জীবনাচরণ ও প্রশ্নশীল মন আমাদের অসাম্প্রদায়িক উদারনৈতিক জীবন ও সমাজগঠন ভাবনায় আদর্শ প্রেরণা।
♦ লেখক : সাংবাদিক sdidar252@gmail.