দুই বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। এরপর গাজা উপত্যকায় আবারও সশস্ত্র টহলে নেমেছে হামাস যোদ্ধারা। ধ্বংসস্তূপে পরিণত শহরজুড়ে তারা আইনশৃঙ্খলা পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। যা একদিকে ইসরায়েল-সমর্থিত দল ও সহযোগীদের জন্য সতর্কবার্তা, অন্যদিকে গাজার শাসনের বাস্তব চিত্রও।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষিত ২০ দফা গাজা পরিকল্পনায় হামাসের কোনো রাজনৈতিক বা সামরিক ভূমিকা থাকবে না বলে বলা হয়েছে। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিকল্প নেতৃত্ব বা কাঠামো না থাকায় হামাসকে সম্পূর্ণ প্রান্তিক করা প্রায় অসম্ভব।
ব্রিটিশ-ফিলিস্তিনি বিশ্লেষক আজ্জাম তামিমি বলেন, হামাস পরাজিত হয়নি। তারা লড়াই করেছে, টিকে আছে, এবং শেষ পর্যন্ত ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের সঙ্গেই চুক্তি করেছে।
চুক্তির অংশ হিসেবে ইসরায়েল ধীরে ধীরে সেনা প্রত্যাহার শুরু করেছে। গাজায় মানবিক সহায়তা ঢুকছে। বন্দি বিনিময় প্রক্রিয়াও চলছে।
যুদ্ধবিরতির পরপরই হামাস শুরু করে অভ্যন্তরীণ শুদ্ধি অভিযান। যুদ্ধকালীন বিশৃঙ্খলায় গাজায় যে সব অপরাধচক্র ও সহযোগী গোষ্ঠী সক্রিয় হয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে বহুজনকে আটক বা হত্যা করা হয়। অন্তত আটজনকে সহযোগী ও অপরাধী অভিযোগে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
ফিলিস্তিনি বিশ্লেষক মোহাম্মদ শেহাদা বলেন, হামাস শুধু অপরাধীদের দমন করছে না বরং অস্ত্রের ওপর পুনরায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে গাজার অভ্যন্তরে ছোট অস্ত্র ছড়িয়ে দিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল।
স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও হামাসের এই পদক্ষেপের পক্ষে মত দিয়েছেন। গাজার সবচেয়ে বড় গোত্র সংগঠনের প্রধান হুসনি সালমান হুসেইন আল-মুঘনি বলেন, যারা শিশু হত্যা করেছে, ত্রাণ লুট করেছে বা ইসরায়েলের হয়ে কাজ করেছে হামাস তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিচ্ছে।
যুদ্ধবিরতির পরও হামাসের হাতে থাকা অস্ত্র আন্তর্জাতিক মহলে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল যেখানে সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের দাবি জানাচ্ছে, সেখানে হামাস স্পষ্ট জানিয়েছে, একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তারা অস্ত্র ত্যাগ করবে না।
হামাসের সিনিয়র নেতা বাসেম নাঈম বলেন, আমাদের প্রতিরোধের অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, হামাসকে অবিলম্বে, এমনকি প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ নিরস্ত্র করা হবে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, ইতিহাস বলে সামরিক শক্তি দিয়ে এমন সংগঠনকে (হামাস) ধ্বংস করা প্রায় অসম্ভব। ২০০৮ সালের র্যান্ড করপোরেশনের গবেষণা অনুযায়ী, বেশিরভাগ সশস্ত্র গোষ্ঠী শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত হয়েছে।
যুদ্ধোত্তর গাজায় হামাস প্রশাসনিক দায়িত্ব হস্তান্তরের ইঙ্গিত দিয়েছে। তবে তারা সম্পূর্ণ সরে দাঁড়াবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। সংগঠনের নেতারা গোপনে জানিয়েছেন, ইসরায়েলের পূর্ণ প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত তারা নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবে।
গাজার জনগণের মধ্যে যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞে ক্ষোভ থাকলেও হামাসের প্রতি সহানুভূতি এখনও প্রবল। জরিপে দেখা গেছে, অধিকাংশ ফিলিস্তিনি নিরস্ত্রীকরণের বিপক্ষে এবং সশস্ত্র প্রতিরোধের পক্ষে।
বিশ্লেষক শেহাদা বলেন, যারা একসময় হামাসের কট্টর সমালোচক ছিল, তারাই গণহত্যার পর সবচেয়ে জোরালো সমর্থক হয়ে উঠেছে। কারণ তারা দেখেছে, পুরো বিশ্ব চুপ থাকলেও গাজার সাধারণ তরুণরাই প্রতিরোধ করেছে।
মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ হেলেনা কোববান বলেন, হামাসের নেতৃত্ব সত্ত্বেও ঐক্যবদ্ধভাবে আলোচনায় অংশ নিয়েছে। তাই ধরে নেওয়া অবাস্তব যে তারা ভবিষ্যৎ গাজা প্রশাসনে কোনো ভূমিকা রাখবে না।
হামাস সূত্রে জানা যায়, ভবিষ্যতে তারা সরাসরি সরকার গঠন না করে ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগঠন (পিএলও)-এর মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
গাজার রাজনীতি তাই এখন নতুন এক সন্ধিক্ষণে। যেখানে যুদ্ধবিরতি কেবল বিরামচিহ্ন বা সমাপ্তি নয়।
সূত্র: মিডলইস্ট আই
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল