পাপিয়ার সঙ্গে আমার কীসের খাতির এই প্রশ্ন নিয়ে সেবার সংসদে মেলা হইচই হলো। বিশেষ করে সুইডিশ পার্লামেন্টের আমন্ত্রণে আমি, পাপিয়া ও চুমকি আপা যখন দীর্ঘ এক মাস ভ্রমণ করে এলাম এবং সেই ভ্রমণকাহিনি নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনে লিখলাম তখন তোফায়েল ভাই আমাকে ডেকে পাঠালেন। সৈয়দ আশরাফ সাহেব, সুরঞ্জিত দাদা ও আমু ভাইয়ের সামনে আমাকে লম্বা জেরা করলেন। তৎকালীন স্পিকার এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদও একদিন এত্তেলা দিয়ে তাঁর কামরায় ডেকে নিলেন। সবার একই প্রশ্ন- পাপিয়ার সঙ্গে আমার কীসের এত খাতির। আমার মতো ভ্যাদভ্যাদা কাদামাটির ভ্যাদা মাছ স্বভাবের নরম মানুষের সঙ্গে অগ্নিকন্যা পাপিয়ার কি করে বন্ধুত্ব হয়!
আওয়ামী লীগের লোকজনের মতো বিএনপির সংসদ সদস্যরাও অবাক হতেন- যখন তাঁরা দেখতেন সংসদে আমরা খুনশুটি কিংবা চিঠি চালাচালি করছি। সংসদের আর্দালিরা ওসব চিঠি আনা-নেওয়া করতেন। আমি কী লিখলাম তা দেখার জন্য পাপিয়ার সহকর্মীরা তাঁকে ঘিরে ধরতেন। আর পাপিয়ার চিঠি পড়ার জন্য আমার চারপাশে থাকা সংসদ সদস্যরা বিশেষত বন্ধুবর ইকবালুর রহিম, নজরুল ইসলাম বাবু, মুরাদ জং, নসরুল হামিদ বিপু প্রমুখ বেশি মজা পেতেন। আমাদের চিঠিগুলো ছিল সংসদ অধিবেশনে বিভিন্ন বক্তার বক্তব্য নিয়ে হাস্যরসাত্মক কটাক্ষ। আমার চিঠিতে সাহিত্য থাকত কিন্তু পাপিয়া যা লিখতেন তাতে নির্মম আওয়ামী লীগ সমালোচনার সঙ্গে এবং কিছু প্রাগৈতিহাসিক শব্দ ব্যবহার করতেন, যা পড়ে আমার সহকর্মীরা হেসে গড়াগড়ি দিতেন।
আমি যে সময়ের কথা বলছি সেটা ছিল ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল অবধি। যত দিন বিএনপি পার্লামেন্টে ছিল তত দিন সংসদের ভিতরে এবং বাইরে বিএনপির তরুণ তুর্কি এবং আওয়ামী লীগের তরুণ তুর্কিদের মধ্যে অসাধারণ একটা সম্পর্ক ছিল। আওয়ামী লীগের দলীয় রাজনীতিতে আমার অতীত কার্যক্রম ইকবাল বা বাবুর মতো গুরুত্বপূর্ণ না হলেও সংসদীয় রাজনীতিতে কেন জানি আমার প্রতি দেশবাসীর একটি তীব্র আকর্ষণ ছিল। অন্যদিকে দলীয়প্রধান আমাকে স্নেহ করেন এমন খবর কিংবা কারা যেন ছড়িয়ে দিয়েছিল যার ফলে দল এবং সংসদীয় কমিটিতে আমাকে নিয়ে বেশ মাতামাতি ছিল।
এদিকে পাপিয়ার অবস্থা ছিল আমার থেকে কয়েক গুণ চড়া। বেগম জিয়ার স্নেহ ছাড়াও বিএনপির রাজনীতিতে তাঁর আজীবনের শ্রমসাধনা এবং ঝুঁকির সঙ্গে তুলনা করা যায় এমন মহিলা নেত্রী বিএনপিতে দ্বিতীয়টি নেই। রাজপথের গর্জন, মারদাঙ্গা আচরণ, জনসভাতে অগ্নিঝরা বক্তব্য এবং সংসদকাঁপানো ভাষণের পাশাপাশি টক শোগুলোতে পাপিয়ার দাপটে আওয়ামী লীগের লোকজন রীতিমতো পাপিয়াফোবিয়াতে আক্রান্ত ছিল। বিশেষত বিচারপতি মানিকের ওপর ওরা আদালতে আক্রমণ এবং সেই কারণে জেল খাটাসহ রাজপথে পুলিশের জলকামানের সামনে পাপিয়া ও শাম্মীর একটি ছবি ভাইরাল হওয়ার পর আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা পাপিয়াকে ভয় পেতেন। অন্য মহিলা সংসদ সদস্যরা চাইতেন সংসদে পাপিয়ার বক্তব্যের দাঁতভাঙা জবাব দেওয়ার জন্য। এজন্য আওয়ামী লীগের অনেক মহিলা সংসদ সদস্য আমার কাছে আসতেন কিছু দাঁতভাঙা শব্দ লিখে নেওয়ার জন্য। পাপিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব সত্ত্বেও আমি আওয়ামী লীগের মহিলা এমপিদের এমন কিছু বাক্য লিখে দিতাম যা পুরো সংসদের বিতর্ককে আরও প্রাণবন্ত করে তুলত।
সম্মানিত পাঠক হয়তো ভাববেন, আমি এত দিন পর কেন পাপিয়ার গল্প শোনাচ্ছি। অথবা পাপিয়ার গল্প শুনে আপনাদের কী লাভ! এসব প্রশ্নের কোনো সরাসরি জবাব নেই। তবে চলমান রাজনীতির দুর্ভিক্ষ এবং আগামীর রাজনীতির বন্ধ্যত্ব অনুমান করার পর প্রায়ই অতীত নিয়ে নস্টালজিয়ায় ভুগি। আমার ভাঙাচোরা জীবনে অনেক কিছু দেখার সুযোগ হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতির অগ্নিগর্ভ সময় ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ, ১৯৭৫ সালের নির্মম হত্যাকাণ্ড, ১৯৭৯ সালের নির্বাচনসহ ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের বহু ঘটনা ত্রিমাত্রিকভাবে অনুধাবনের সুযোগ হয়েছে। এমনকি বয়স অল্প হলেও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতি আমার হৃদয়ে অম্লান হয়ে আছে। কিন্তু চলমান সময়ের মতো এমন জগদ্দল পাথরের বোঝা কোনো দিন মনমস্তিষ্কে আঘাত করেনি।
চলমান সময়ের ভয়-আতঙ্ক-অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণে যেভাবে মানুষের স্বপ্ন কর্পূরের মতো উড়ে গেছে তাতে করে বেঁচে থাকার জন্য আমার মতো অনেকেই শাহ আবদুল করিমের গানের ন্যায় আপন মনে বিড় বিড় করেন- আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম এবং বর্তমান-ভবিষ্যৎ ভুলে অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন। আমিও স্মরণ করার চেষ্টা করি আশির দশকে আমার সাংবাদিকতার স্বর্ণালি দিনগুলো।
১৯৯১ সাল থেকে করোনা-পূর্ববর্তীকালের সুদীর্ঘ ব্যবসায়িক সাফল্য এবং ২০০১ থেকে ২০২৪ সাল অবধি জাতীয় রাজনীতিতে আমার সক্রিয় অংশগ্রহণসহ শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, লেখালেখি, ধর্মকর্ম নিয়ে সীমাহীন ব্যস্ততা। কিন্তু গত প্রায় এক বছর শরীর, মন, সমাজ, সংসার এবং রাষ্ট্রীয় বিধিব্যবস্থায় যে মরুঝড় বইছে তাতে করে উটের মতো শরীর ভাঁজ করে নাক-মুখ রক্ষার জন্য যারা চেষ্টার পাশাপাশি বেহুঁশ না হওয়ার জন্য অতীত নিয়ে চিন্তাভাবনা করে বেঁচে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁদের অনুকরণে আমিও আমার রাজনীতির স্বর্ণালি সময়ের কিছু স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে পাপিয়ার প্রসঙ্গ চলে এসেছে।
২০১৩ সালের পর বিএনপি-আওয়ামী লীগের সম্পর্ক তলানিতে চলে যায়। তারপরও রাজনীতিতে যে সৌজন্যতা ছিল তা আজকের জমানায় কল্পনাও করা যায় না। ২০১৬ সালের ঘটনা। আমি তখন বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত কলাম লিখতাম। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, তোফায়েল আহমেদসহ অনেক স্বনামধন্য পাঠক আমার নিবন্ধ পাঠ করে ফোন দিতেন এবং পক্ষে-বিপক্ষে মতামত দিতেন। তো একদিন তোফায়েল ভাই বেশ অভিমান করেই বললেন, ‘দ্যাখ রনি! কাজটা কিন্তু ভালো হলো না। মির্জা ফখরুলের মতো নিপাট ভদ্রলোকের বিরুদ্ধে যেভাবে মামলা দেওয়া হলো তা কিন্তু আওয়ামী লীগকে ভোগাবে।’
আমি জানি না বর্তমান বিএনপি-এনসিপি বা জামায়াতে তোফায়েল ভাইয়ের মতো কোনো শীর্ষ নেতা আছেন কি না, যারা চলমান রাজনীতি নিয়ে কোনো রাজনৈতিক নেতা, কলামিস্ট বা সাংবাদিকের কাছে ভিন্নমত প্রকাশ করেন এবং তা আবার সেই সাংবাদিক আমার মতো করে হুবহু পত্রিকায় লিখে দেন। ফ্যাসিস্ট আমলে আমি লিখতাম শেখ হাসিনার সরকারে কোনো চেইন অব কমান্ড নেই। আরও লিখতাম ওবায়দুল কাদের একটা ফাটাকেস্ট। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্ক্রু ১৯৮৬ সালেই ঢিলা হয়ে গেছে। সুতরাং তাঁকে দিয়ে হবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর, সাহারা খাতুন ও সামসুল হক টুকুর নির্মম সমালোচনা করেছি। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো, যাঁদের বিরুদ্ধে লিখেছি তাঁরা সবাই ফোন করে আত্মúক্ষ সমর্থন করেছেন আর পরবর্তী সময়ে কোনো অনুষ্ঠানে দেখা হলে এগিয়ে এসে করমর্দন করেছেন।
রাজনীতির উল্লিখিত সংস্কৃতির কারণেই পাপিয়ার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল এবং তা হয়েছিল তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং সৈয়দ আশরাফের মতো মানুষের হুইবিংয়ের কারণে। যেদিন তোফায়েল ভাই আমাকে পাপিয়ার বিষয়ে জেরা করার জন্য ডেকেছিলেন তার ঠিক আগের রাতে একটি টেলিভিশনের টক শোতে পাপিয়ার দ্বারা আমি নিদারুণভাবে নাজেহাল হয়েছিলাম। পাপিয়ার ক্ষীপ্রতা, যুক্তি এবং কথার মঞ্চ দখল করার কৌশলের কাছে আমার নাস্তানাবুদ হওয়ার দৃশ্য দেখে তোফায়েল ভাই ডেকে নিয়েছিলেন। বুঝিয়েছিলেন কীভাবে পাপিয়ার মতো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কথার মারপ্যাঁচে তথ্য-উপাত্ত এবং ধৈর্য দ্বারা মোকাবিলা করা যায়। দ্বিতীয়ত তিনি বুঝিয়েছিলেন কীভাবে প্রতিপক্ষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে বিরক্তিকর দায়িত্ব এড়ানো যায়।
তোফায়েল ভাই যখন উল্লিখিত কথাগুলো বলছিলেন তখন সৈয়দ আশরাফ, আমু ভাই ও সুরঞ্জিত দাদাও কিছু মূল্যবান পরামর্শ দিলেন। আমি মন্ত্রমুন্ধের মতো তাঁদের কথাগুলো শুনেছিলাম এবং পরবর্তী সময়ে তা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যে সফলতা পেয়েছিলাম তা রীতিমতো বিস্ময়কর। ২০০৯ সাল থেকে অদ্যাবধি প্রায় চার হাজার টক শো করেছি। কখনো সহ-আলোচকের সঙ্গে বিরূপ পরিস্থিতি তৈরি হয়নি কেবল আওয়ামী লীগের আহম্মদ হোসেন ছাড়া। অধিকন্তু টক শো, সভা-সমিতি, সেমিনার করতে গিয়ে পাপিয়ার মতো অনেকের সঙ্গে এমন পারিবারিক বন্ধুত্ব হয়েছে যা জীবনের অর্জিত অন্য সব সহায়সম্পত্তি, বিত্তবৈভবের চেয়ে কোনো অংশে কম মূল্যবান নয় বরং ক্ষেত্রবিশেষে অমূল্য।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক