জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা জোবায়েদ হোসাইন হত্যার নেপথ্যে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর ত্রিভুজ প্রেমের গল্প। যে ঘটনায় জোবায়েদের ছাত্রী ও প্রেমিকা বারজিস সাবনাম বর্ষার সঙ্গে বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যার খলনায়িকা আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির মিল খুঁজে পাচ্ছে পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, বর্ষা নিজেই হত্যার পরিকল্পনার ছক আঁকেন। আর সেটি বাস্তবায়ন করেন তার আরেক প্রেমিক মো. মাহির ছটফট করছিলেন, তখনো মন গলেনি বর্ষার। উল্টো তিনি জোবায়েদের উদ্দেশে বলেন, ‘তুমি না সরলে আমি মাহিরের হতে পারব না।’ এর কিছু সময় পরেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান জোবায়েদ। এদিকে জবি ছাত্র জোবায়েদ হত্যায় গতকাল ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বর্ষাসহ গ্রেপ্তার তিন আসামি। গতকাল দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) এস এন নজরুল ইসলাম এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, চতুর স্বভাবের বর্ষা একই সময়ে তার গৃহশিক্ষক জোবায়েদ এবং প্রতিবেশী মাহিরের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছিলেন। মাহির এক সময় বর্ষাদের ভবনেই থাকতেন। ৭-৮ বছরের জানাশোনা থেকে দেড় বছর আগে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। এরপর জোবায়েদ বর্ষাকে পড়ানো শুরু করেন। বর্ষা জোবায়েদেরও প্রেমে পড়েন। জোবায়েদের সঙ্গে প্রেমের বিষয়টি মাহির জেনে যাওয়ার পর বর্ষার সঙ্গে মনোমালিন্য হয়। এমন অবস্থায় মাহিরকে তার প্রেমিকা বর্ষা বলেন- ‘জোবায়েদকে না সরাতে পারলে আমি তোমার হতে পারব না।’
এ কথার পরেই ২৫ দিন আগে গত ২৬ সেপ্টেম্বর জোবায়েদকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন বর্ষা ও মাহির। পরবর্তীতে মাহির ও তার বন্ধু আয়লান মিলে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের আগানগর বউবাজার এলাকা থেকে চাকু কিনে গত রবিবার বর্ষার বাসায় অবস্থান নেন। আর বর্ষা তার শিক্ষক ও প্রেমিক জোবায়েদকে মোবাইল ফোনে ডেকে আনেন। এর পরই বর্ষার বাসার সিঁড়িতে জোবায়েদকে বলা হয় বর্ষা থেকে সরে যেতে। এ নিয়ে তর্কবিতর্কের একপর্যায়ে জোবায়েদের গলায় ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায় তারা। এই হত্যাকাণ্ডে রাজনৈতিক কোনো বিষয় নেই বলে নিশ্চিত করেন অতিরিক্ত কমিশনার। হত্যার মুহূর্তে জোবায়েদের প্রেমিকা বর্ষার ভূমিকার বিষয়ে ডিএমপির লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মল্লিক আহসান উদ্দিন সামী বলেন, বর্ষা আমাদের নিশ্চিত করেছে, জোবায়েদ মারা যাওয়ার সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন। তদন্তে জানা গেছে, জোবায়েদের শেষ কথা ছিল বর্ষাকে উদ্দেশ করে- ‘আমাকে বাঁচাও’। বর্ষা তখন জোবায়েদের উদ্দেশে বলেন, ‘তুমি না সরলে আমি মাহিরের হব না’। তদন্তে উঠে এসেছে, দোতলার সিঁড়িতে জোবায়েদকে ছুরিকাঘাত করা হয়। এ সময় তিনি বাঁচার চেষ্টা করছিলেন। বর্ষাদের বাসা পাঁচ তলায় হলেও ঘটনার সময় তিনি তিন তলার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নিচের হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেন। জোবায়েদ প্রথমে দোতলার কলিংবেল বাজিয়ে দরজায় ধাক্কা দেন এবং দরজা থেকে রক্ত নিচে গড়িয়ে পড়ছিল। দোতলার বাসিন্দার দরজা খুলতে দেরি হওয়ায় জোবায়েদ তৃতীয় তলায় গেলে বর্ষাকে দেখতে পান।
প্রসঙ্গত, রবিবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে বংশাল থানার ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের নুর বক্স লেনের ১৫ নম্বর রৌশান ভিলার সিঁড়িতে জোবায়েদ খুন হয়েছেন। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্রুত অভিযান চালিয়ে সোমবার রাতে কেরানীগঞ্জের ভাগনা এলাকা থেকে মাহিরকে ও পল্টনের চামেলীবাগ থেকে আয়লানকে আটক করে। তার আগে গত রবিবার রাতেই বংশাল থেকে বর্ষাকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের হলে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। মামলার বাদী হন জোবায়েদের ভাই এনায়েত হোসেন সৈকত।
তিন অভিযুক্তের স্বীকারোক্তি : এদিকে গতকাল আদালতে তিন অভিযুক্ত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ঢাকা মহানগর আদালতের ৪ বিচারক তাদের খাস কামরায় জবানবন্দি ও সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। এর মধ্যে মেহেদী হাসানের আদালতে মাহির, মাসুম মিয়ার আদালতে বর্ষা ও মো. জুয়েল রানার আদালতে আয়লান জবানবন্দি দেন। এ ছাড়া মো. হাসিবুজ্জামানের আদালতে প্রিতম চন্দ্র দাসের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী জানান, আসামিরা স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিতে রাজি হওয়ায় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও বংশাল থানার উপপরিদর্শক মো. আশরাফ হোসেন জবানবন্দি রেকর্ডের আবেদন করেন। জবানবন্দি শেষে তিনজনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
জবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ : দোষীদের ফাঁসি দাবি করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীরা আদালতে বিক্ষোভ করেছেন। এ সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিক্ষোভে শাখা ছাত্রদল, ছাত্র অধিকার পরিষদ, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, আপ বাংলাদেশসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সরব উপস্থিতি দেখা যায়। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে থেকে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বিশ্বজিৎ চত্বর, শাঁখারীবাজার হয়ে আদালত প্রাঙ্গণে এসে সমাবেত হয়। এ সময় তারা বিভিন্ন স্লোগান দেন।