তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরানোর আপিল শুনানিতে বলা হয়েছে, বায়বীয় ধারণার ভিত্তিতে ত্রয়োদশ সংশোধন বাতিল করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ত্রয়োদশ সংশোধন বাতিলের রায়টি আইনগতভাবে দুর্বল, কাঠামোগতভাবে দুর্বল। ত্রয়োদশ সংশোধন বাতিলের রায় সংবিধানের মৌলিক কাঠামোয় আঘাত করেছে। ফলে জনগণের সার্বভৌমত্ব, মৌলিক অধিকার কিংবা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মতো সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
গতকাল প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত আপিল বেঞ্চে ত্রয়োদশ সংশোধন ফিরিয়ে আনার পক্ষে শুনানিতে অংশ নিয়ে এ বক্তব্য উপস্থাপন করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরীফ ভুঁইয়া। শুনানির শুরুতে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মামলাটির শুনানি হবে। মামলাটি কার্যতালিকার শীর্ষে রাখতে বলা হয়েছে। ত্রয়োদশ সংশোধন বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ আপিলকারীর আইনজীবী তিনি। এ সময় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ। বিএনপি মহাসচিবের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ও মো. রুহুল কুদ্দুস কাজল। জামায়াতের পক্ষে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির উপস্থিত ছিলেন। আজও এ বিষয়ে শুনানির জন্য দিন ধার্য রেখেছেন আপিল বিভাগ।
১৪ বছর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে রায় দিয়েছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। পরে এ রায় নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। খায়রুল হকের বিরুদ্ধে রায় পরিবর্তনের অভিযোগ ওঠে। ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এ রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে গত বছরের ২৭ আগস্ট আবেদন করেন বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি। পরে ১৭ অক্টোবর আবেদন করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এর পাঁচ দিন পর ২৩ অক্টোবর আরেকটি আবেদন করেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। এ ছাড়া আরেকটি আবেদন করেন নওগাঁর রানীনগরের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন। এরপর আরও দুটি আবেদন করা হয়।
এরপর রিভিউ আবেদনে আপিল করার অনুমতি দিয়ে আপিল শুনানি হবে, নাকি রিভিউ আবেদনেই চূড়ান্ত শুনানি হবে-এ নিয়ে দুই দিন শুনানির পর গত ২৭ আগস্ট সর্বোচ্চ আদালত সিদ্ধান্ত জানান। এ সময় ছয়টি আবেদনের মধ্যে একটি আবেদনে আপিলের অনুমতি দিয়ে অন্য চারটি আবেদনকে একই পক্ষভুক্ত করে দেন আপিল বিভাগ। অন্য আবেদন কার্যতালিকা থেকে বাদ (আউট অব লিস্ট) দিয়ে শুনানির দিন ধার্য করেন আদালত। তারই ধারাবাহিকতায় গতকাল প্রথম শুনানি শুরু হয়।
শুনানিতে আইনজীবী শরীফ ভুঁইয়া বলেন, সাংবিধানিক বিষয় ব্যাখ্যা করার কিছু রীতিনীতি, পদ্ধতি আছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাসংক্রান্ত ত্রয়োদশ সংশোধন বাতিল করার ক্ষেত্রে সেই রীতিনীতি, পদ্ধতি অনুসরণ করেননি। অথবা প্রয়োগ করতে ভুল করেছেন। তিনি আরও বলেন, সংবিধান ব্যাখ্যা করতে হলে দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে তার ফলাফল কী দাঁড়াবে, তা বিবেচনায় নিতে হয়। বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিল। সেই ইতিহাসও কিন্তু সংবিধান ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। কিন্তু সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ এ বিষয়গুলো বিবেচনা করেননি। উনারা দেশের বাস্তবতা বিবেচনায় নেননি। বায়বীয় ধারণার ভিত্তিতে ত্রয়োদশ সংশোধন বাতিল করেছেন। শুধু তাই নয়, ত্রয়োদশ সংশোধন বাতিলের রায়টি আইনগতভাবে দুর্বল, কাঠামোগতভাবে দুর্বল। উনাদের রায়ের ফলে দেশ যে গণতন্ত্রহীন হয়ে যাবে, স্বৈরতন্ত্র-একনায়কতন্ত্র চালু হবে এবং এক হাজার মানুষকে জীবন দিয়ে সরকার পরিবর্তন করতে হবে, এসব কিছুই উনারা বুঝতে পারেননি। একটি সাংবিধানিক আদালত হিসেবে এগুলো বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল। উনারা আইন বুঝতেও ভুল করেছেন, আইন প্রয়োগ করতেও ভুল করেছেন। ফলে এটা কমপ্লিটলি রং হেডেড ডিসিশন। সম্পূর্ণভাবে ভুল একটা জাজমেন্ট।