দেশের অন্যতম বড় হুন্ডি ও মাফিয়া চক্রের নজর পড়েছে মার্কিন মুলুকেও। এই চক্রের থাবা থেকে বাদ যায়নি মার্কিন নাগরিকও। তাদের খপ্পরে পড়ে তিনি খুইয়েছেন ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। সিআইডির হাতে তথ্য এসেছে যে, এই চক্রের ৯৬টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে মাত্র এক বছরেই লেনদেন করেছে ৬০৮ কোটি টাকারও বেশি। আর একজনের অ্যাকাউন্টেই লেনদেন হয়েছে ৫৮২ কোটি টাকা। তবে অবাক করা তথ্য হলো- ২০২৩ সালে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশের কাছে এই বিষয়ে সহায়তা চাইলেও তৎকালীন সিআইডি প্রধানের হস্তক্ষেপে থেমে যায় এর অনুসন্ধান।
সিআইডির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. ছিবগাত উল্লাহ বলেন, আমরা এই চক্রের অনেক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের তথ্য পেয়েছি। তাদের মধ্যে একজন মার্কিন নাগরিকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া স্বর্ণ চোরাচালান ও বৈদেশিক মুদ্রা পাচারে তাদের জড়িত থাকার প্রমাণও হাতে এসেছে। চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে দেশের বাইরে ও ভিতরে হুন্ডি কার্যক্রম চালাচ্ছিল।
সিআইডি সূত্র জানায়, চক্রের মূল হোতা মনীন্দ্র নাথ বিশ্বাসের অ্যাকাউন্টে গত এক বছরে ৫৮২ কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া গোলাম সারওয়ার আজাদ ও তরিকুল ইসলাম রিপন ফকিরের অ্যাকাউন্টে আরও ১০০ কোটি টাকার লেনদেন মিলেছে। এই চক্র বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে হুন্ডি ও মানি লন্ডারিং কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর মধ্যে আইনক্স ফ্যাশন, ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজ, জামান এন্টারপ্রাইজ ও নোহা এন্টারপ্রাইজ উল্লেখযোগ্য।
জানা গেছে, চক্রটি শুধু অর্থ আত্মসাৎ নয়, স্বর্ণ চোরাচালানেও জড়িত। তাঁতিবাজারসহ বিভিন্ন স্থানের দোকান থেকে ভাঙারি স্বর্ণ সংগ্রহ করে তা গলিয়ে বার আকারে রূপান্তরিত করে বিদেশে পাচার করা হয়। এসব স্বর্ণ ভারতের সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে পাচার করা হয়।
একাধিক সূত্র বলছে, দেশের বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে তার তুলনায় হুন্ডির মাধ্যমে পাচার আরও বেশি। প্রতিবছর প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে যাচ্ছে। ডিজিটাল হুন্ডি ও অ্যাপ-ভিত্তিক লেনদেনের কারণে অপরাধীদের শনাক্ত করা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। সুইস ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশিরা ৫,৩৬৭ কোটি টাকা সুইস ব্যাংকে রেখেছিল। ২০২০ সালে তা কমে ৫,৩৪৭ কোটি এবং ২০২১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৮,২৭৫ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, চক্রের সদস্যরা কৌশল করে যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরদেরও ব্যবহার করেছে। মার্কিন নাগরিক ‘ডেবি’র সঙ্গে সখ্য তৈরি করে। পরবর্তীতে তাদের একজন নিজেকে ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট বিভাগের এজেন্ট দাবি করে ভয় দেখায়। তার বাড়ি তল্লাশি করতে চায়। একপর্যায়ে ২ লাখ ৭০ লাখ টাকায় ‘ডেবি’র সঙ্গে তাদের রফা হয়। তবে এই টাকা বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকদের নামে বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে। সবশেষে চক্রটি হুন্ডির মাধ্যমে সেই অর্থ ফের বিদেশে স্থানান্তরিত করে।
সূত্র আরও বলছে, এই সংঘবদ্ধ চক্র প্রতারণা ও হুন্ডি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নামসর্বস্ব বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে দীর্ঘদিন ধরে বড় অঙ্কের টাকা লেনদেন করে আসছে। অনুসন্ধানে উঠে আসা এসব প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- আইনক্স ফ্যাশন, ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজ, জামান এন্টারপ্রাইজ ও নোহা এন্টারপ্রাইজ। এর মধ্যে আইনক্স ফ্যাশনের নামে ইউসিবিএল-এ ১টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজের নামে ঢাকা ব্যাংক লি., ওয়ান ব্যাংক লি., এবি ব্যাংক লি. ও এনআরবিসি ব্যাংক লি.-এ পৃথক চারটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, জামান এন্টারপ্রাইজের নামে ব্র্যাক ব্যাংক লি.-এ ১টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, নোহা এন্টারপ্রাইজের নামে সাউথ-ইস্ট ব্যাংক লি.-এ ১টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এসব ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বিপুল পরিমাণ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত লেনদেনের রেকর্ড রয়েছে। এ ছাড়াও মামলায় প্রধান অভিযুক্ত মনীন্দ্র নাথ বিশ্বাস নামীয় অ্যাকাউন্টেও অবৈধ লেনদেনের তথ্য উঠে এসেছে।
সিআইডির একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, বর্তমানে অপরাধীরা স্মার্টলি প্রযুক্তি ব্যবহার করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নজর এড়িয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে তারা ডিজিটাল হুন্ডি অ্যাপ ও বিভিন্ন অনলাইন চ্যানেল ব্যবহার করছে। এজন্য মানি লন্ডারিংসহ আর্থিক দুর্নীতি তদন্তে দেশে-বিদেশে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মকর্তাদের দক্ষ করে গড়ে তোলার বিকল্প নেই। মার্কিন নাগরিকের সঙ্গে প্রতারণার চক্রটিও নানা ধরনের অ্যাপ ব্যবহার করছে।
অনেকগুলো সম্বন্ধে তাদের ধারণাও নেই। জানা গেছে, চক্রটি শুধু অর্থ আত্মসাৎ ও হুন্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে তারা দীর্ঘদিন ধরে স্বর্ণ চোরাচালানও চালাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত ব্যক্তিদের মাধ্যমে স্বর্ণ আনিয়ে এবং ঢাকার তাঁতীবাজারসহ অন্যান্য স্থানের বিভিন্ন দোকান থেকে ভাঙারি স্বর্ণ সংগ্রহ করে তা গলিয়ে পাকা সোনার বার তৈরি করছে। পরবর্তীতে তা সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করছে। মার্কিন নাগরিকের সঙ্গে প্রতারণার ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় দায়ের হওয়া মামলায় ৬০৮ কোটি ৩৩ লাখ ৩০ হাজার ৩৭২ টাকা প্রতারণা মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলা নম্বর-২৪। মামলাটি তদন্ত করছেন উপপরিদর্শক সোহানুর রহমান এবং তদারকি করছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মঞ্জুরুল ইসলাম। মামলার প্রধান অভিযুক্তরা হলেন- মনীন্দ্র নাথ বিশ্বাস, ওয়াহিদুজ্জামান, গোলাম সারওয়ার আজাদ, তরিকুল ইসলাম রিপন ফকির, রাজীব সরদার ও উজ্জ্বল কুমার সাধু। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা পাঁচ-সাতজনের বিরুদ্ধেও মামলা চলছে।