বরেণ্য চলচ্চিত্রকার ও নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস কাঞ্চন সাত মাস ধরে অসুস্থ এবং ছয় মাস ধরে লন্ডনে চিকিৎসাধীন। এ চলচ্চিত্রকারের সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাংবাদিক লিটন আরশাদ যিনি কি না ইলিয়াস কাঞ্চনের শারীরিক অবস্থার বিষয়ে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, গত রবিবার পর্যন্ত ১৩টি কেমো দেওয়া হয়েছে। বাকি আছে আরও ১৬টি। এই মুহূর্তে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসকের সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। লিটন আরশাদ জানান, ইলিয়াস কাঞ্চন অনেক কষ্টে এখন কিছুটা হাঁটতে পারলেও তার ঘুম কম হয়, স্মৃতিশক্তি অনেক কমে গেছে, খাওয়াদাওয়া তেমন করতে পারছেন না। তাঁর কথা বলতেও অনেক কষ্ট হয়। লিটন আরশাদ আরও জানান, এর আগে ইলিয়াস কাঞ্চনের অন্য শারীরিক সমস্যা যেগুলো ছিল যেমন হাই ব্লাড প্রেসার, কলেস্টেরল ও ডায়াবেটিস এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
এদিকে, তাঁর মেয়ে জামাতা আরিফুল ইসলাম গত সোমবার লন্ডন থেকে জানিয়েছেন, ‘আব্বু এখন আগের চেয়ে কিছুটা ভালো আছেন। তবে আরও দুই সপ্তাহ পরই তাঁর শারীরিক অবস্থার প্রকৃত চিত্র বোঝা যাবে। চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী এরপর পরবর্তী ধাপের চিকিৎসা শুরু হবে। সান্ত্বনার বিষয় হলো গত কয়েকদিনের তুলনায় এখন আব্বু অনেকটাই ভালো আছেন। তাঁর মনোবল বেশ দৃঢ় এবং তিনি নিয়মিত দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করছেন। আরিফুল ইসলাম অনুরোধ করেন, দেশবাসী যেন তাদের প্রিয় এই নায়কের দ্রুত আরোগ্যের জন্য দোয়া অব্যাহত রাখেন।
বর্তমানে হাসপাতালে ইলিয়াস কাঞ্চনের পাশে রয়েছেন স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিন ও কন্যা ইশরাত জাহান ইমা, তাঁর জামাতা আরিফুল ইসলাম, পুত্র মিরাজুল মঈন জয় ও তাঁর স্ত্রী ফারিয়া ফাতেহ।
গত ২৬ এপ্রিল চলচ্চিত্রকার ইলিয়াস কাঞ্চনকে অসুস্থ অবস্থায় লন্ডনে হারলি স্ট্রিট ক্লিনিকে নিউরোসার্জারি ডাক্তারের অধীনে নেওয়া হয়। দীর্ঘ তিন মাস নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর গত ৫ আগস্ট লন্ডনের উইলিংটন হাসপাতালে প্রফেসর ডিমিট্রিয়াসের নেতৃত্বে তাঁর মাথায় অস্ত্রোপচার করা হয়। ডাক্তার অপারেশনের আগে জানান পুরো টিউমার অপসারণ করা যাবে না। এতে জীবনহানিসহ প্যারালাইসড হয়ে চলনশক্তি ও কথা বলার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারেন তিনি। ডাক্তারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী টিউমারটির কিছু অংশ অপসারণ এবং বাকি অংশ রেডিয়েশন ও কেমোথেরাপির মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। মোট ৩০ দিন রেডিয়েশন ও কেমোথেরাপি দিতে হবে। সপ্তাহে পাঁচ দিন করে ছয় সপ্তাহ চলবে এই রেডিয়েশন ও কেমোথেরাপির কাজ। এরপর চার সপ্তাহ ডাক্তারের অবজারভেশনে থাকবেন ইলিয়াস কাঞ্চন।
পরিবারের সদস্যরা
এদিকে, ইলিয়াস কাঞ্চনের দুই সন্তানের মধ্যে কন্যা ইশরাত জাহান ইমা বড়। তিনি প্রায় ১৬ বছর আগে বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে লন্ডনে গিয়ে সেখানেই প্রবাসী হন। তাঁর স্বামী আরিফুল ইসলাম কলিন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের ঘরে রয়েছে দুই সন্তান। মেয়ে আরশিয়া বড়। তার বয়স এখন ১১ বছর। ছেলে আরশানের বয়স ছয় বছর। ইমা পুরোদমে গৃহিণী। অন্যদিকে ইলিয়াস কাঞ্চনের পুত্র মিরাজুল মঈন জয় ২০২২ সালে কানাডা চলে যান। সেখানে তিনি একটি ইকোনমিক্যাল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত। তাঁর এক ছেলে। নাম ফায়জান মিরাজ কাঞ্চন। বয়স পাঁচ বছর। সেখানকার একটি স্কুলে পড়াশোনা করছে সে।
১৯৭৯ সালে জাহানারা কাঞ্চনের সঙ্গে ইলিয়াস কাঞ্চনের কাবিন হয়। ১৯৮৩ সালে তাঁকে ঘরে তোলেন। তাঁর স্ত্রী ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর বান্দরবানে ইলিয়াসের চলচ্চিত্রের শুটিং দেখতে যাওয়ার পথে চট্টগ্রামের অদূরে চন্দনাইশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। এর কয়েক বছর পর অভিনেত্রী দিতিকে ভালোবেসে বিয়ে করেন এই অভিনেতা। কিন্তু এই বিয়ে বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। এরপর ২০১০ সালে বিয়ে করেন ফরিদা ইয়াসমিনকে। ইমা ও জয় প্রথম স্ত্রীর সন্তান।
ইলিয়াস কাঞ্চনের ঘটনাবহুল জীবন
চলচ্চিত্রকার ইলিয়াস কাঞ্চনের জীবনের গল্পটি আসলে ফিল্মের মতোই। তিলে তিলে নিজেকে গড়ে তোলেন, যেমনটি করেন চলচ্চিত্রের গল্পের নায়করা। ইলিয়াস কাঞ্চন তেমন একজন সত্যিকারের নায়ক। দিনের পর দিন সংগ্রাম করে, শিখে, বুঝে, শুনে তিনি নায়ক হয়েছেন। সামাজিক চলচ্চিত্রে তাঁকে যেমন মানিয়ে যায়, তেমনি লোক গল্প, রোমান্টিক এমনকি অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্রে নানা সময়ে তিনি নিজেকে প্রমাণ করেছেন। তাঁর শুরু করা আন্দোলন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ জাতীয় স্লোগানে পরিণত হয়েছে। এই গুণী অভিনেতার জন্ম ১৯৫৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার আশুতিয়াপাড়া গ্রামে। পারিবারিক নাম ইদ্রিস আলী। বাবা আবদুল আলী, মা সরুফা খাতুন।
১৯৭৫ সালে কবি নজরুল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন কাঞ্চন। স্কাউটিং করতেন। স্কাউটের ক্যাম্প ফায়ারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। স্কুলে নাটক করেছিলেন মামা-ভাগনের ভাগনে চরিত্রে। তাঁর ভাগনে চরিত্রটি দেখে দর্শক হাততালি দিয়েছিল। স্বাধীনতার পর ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমি’তে রবীন্দ্রসংগীতে তালিম নেন। শিখেছেন নাচও। স্কুলে ‘বাংলার মুক্তি’ নাটকে নায়িকার বাবার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। বন্ধুদের সঙ্গে গঠিত ‘সৃজন সংঘ’ থেকে নাটক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এক সাক্ষাৎকারে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেছিলেন, চলচ্চিত্রে আসার বিষয়ে তাঁর কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছিল না। বিষয়টা হুট করে হয়। তাঁর কথায় ‘আমি তখন পুরান ঢাকায় থাকি। ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে একটা মঞ্চনাটক করি। সেই নাটকে প্রধান অতিথি ছিলেন সুভাষ দত্ত। তিনি আমার কাছাকাছি এলাকায় থাকতেন, ওয়ারীতে। মনে আছে, ওয়াপদা মিলনায়তনে নাটকটি দেখে আমাকে সুভাষ দা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের কথা বলেন। পরদিন সকালে ওয়ারীতে দেখা করার পর তিনি সুসংবাদ দিলেন। যদি পরিবারের কোনো আপত্তি না থাকে, আমাকে নিয়ে তিনি ছবিতে কাজ করতে চান। ১৯৭৭ সালে ওটা আমার প্রথম কাজ। আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’ উপন্যাস অবলম্বনে ছবিটির নাম ছিল ‘বসুন্ধরা’। এ ছবিতে কাজ করার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তাঁকে। আর্ট কলেজে তিন মাস ক্লাস করতে হয়েছে। ইলিয়াস কাঞ্চন বলেছিলেন, ‘সৃষ্টিকর্তা আমাকে সব সময় সাহায্য করেছেন। বারবার সুযোগ দিয়েছেন। ভাগ্য আমার সহায় ছিল। ‘বসুন্ধরা’ প্রথম এবং সাহিত্যনির্ভর ছবি। ছবিটি দর্শক গ্রহণযোগ্যতা ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলে এই নায়ককে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক সুপার হিট ছবি উপহার দিয়ে তিনি অল্প সময়ে হয়ে ওঠেন সুপারস্টার। সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রীকে হারিয়ে নেমেছিলেন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনে। সেই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন এখনো। এভাবে কেটে গেছে ২৬ বছর। তাঁর সংগঠনের নাম এখন জাতীয় স্লোগানে পরিণত হয়েছে। ইলিয়াস কাঞ্চন ২০১৮ সালে একুশে পদক পেয়েছেন। একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ছাড়াও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন এবং বাচসাস পুরস্কার, শেরেবাংলা স্মৃতি পদক, ফজলুল হক স্মৃতি পুরস্কার, চলচ্চিত্র দর্শক পুরস্কার, বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ অ্যাসোসিয়েশন পুরস্কার, ঢাকা সিটি করপোরেশন নগর পুরস্কার, ভয়েস অব আমেরিকা পুরস্কার, বাংলাদেশ কালচারাল মুভমেন্ট পুরস্কার, ঢাকা যুব ফাউন্ডেশন পুরস্কার, ট্রাব অ্যাওয়ার্ডসহ বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন।