কালের স্রোতে অনেক কিছুই হারিয়ে যায়। তারপরও কিছু কিছু ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন কালের সাক্ষী হয়ে থেকে যায়। এসব নিদর্শন আমাদের অতীত ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করে। সেই সেতুবন্ধগুলোকে টিকিয়ে রাখা আমাদের কর্তব্য।
কিন্তু জাতি হিসেবে এ কাজটাকে কেন যেন আমরা গুরুত্বই দিই না। দেশের বিভিন্ন স্থানে অযত্ন-অবহেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো নিয়ে প্রায়ই দৈনিক পত্রিকায় রিপোর্ট হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না।
ঐতিহাসিক নানা কারণে যশোর গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ-ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকার ১৭৮১ সালে যশোরকে জেলা (যশোর কালেক্টরেট) হিসেবে ঘোষণা করে। সেই হিসেবে অনেকেই ১৭৮১ সালকেই যশোর জেলার প্রতিষ্ঠা সাল হিসেবে মনে করেন।
বিভিন্ন নথি থেকে জানা যায়, জেলা হিসেবে পূর্ণাঙ্গ প্রশাসনিক কাঠামো নিয়ে যশোর কালেক্টরেটের যাত্রা হয় ১৭৮৬ সালের ৫ এপ্রিল। তাই এ দিনটিই যশোর জেলার জন্মদিন।
জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর মুড়লীতে কালেক্টরেটের কার্যক্রম চালানো হয়। পরে ১৮০১ সালে কসবায় (অর্থাৎ বর্তমানে যশোর শহরে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের বিপরীতে পূর্ব পাশে যেখানে রেজিস্ট্রি অফিস) স্থায়ী কালেক্টরেট ভবন নির্মাণ করা হয়।
১৮৫৮ সালের ২৩ আগস্ট ব্রিটিশ সরকারের অধীনে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে চাকরিজীবন শুরু করেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী যুগ-প্রবর্তক লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর দপ্তর ছিল এই কালেক্টরেট ভবনে। সময়ের পরিক্রমায় আজ সেই ভবনটি জরাজীর্ণ, পরিত্যক্ত।
১৮০১ সালে এই কালেক্টরেট ভবন নির্মাণের পরের বছরই অর্থাৎ ১৮০২ সালে ভবন প্রাঙ্গণে নির্মাণ করা হয়েছিল একটি সূর্যঘড়ি। প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে তখনকার কালেক্টর মিস্টার রোক এ সূর্যঘড়িটি স্থাপন করেন। এ ঘড়িটি বাংলাদেশের প্রাচীনতম সূর্যঘড়িগুলোর অন্যতম, যার বয়স এখন ২২৩ বছর।
ঐতিহাসিক এই সূর্যঘড়িটির অবস্থা এখন উদ্বেগজনক। ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এরকম একটি উপাদান আজ দলিল লেখকদের টিনশেড আর বেড়ার মধ্যে কম্পিউটার-প্রিন্টারের ভিড়ে অদৃশ্য হয়ে আছে। সূর্যঘড়িটি আজ নিজেই বঞ্চিত সূর্যের আলো থেকে।
যশোরবাসী প্রত্যাশা করে, দ্রুত এই সূর্যঘড়িটিকে দখলমুক্ত করা হোক। প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাস বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ঘড়িটিকে সংস্কার করতে হবে এবং এ নিদর্শনটি ঐতিহ্যের অমূল্য স্মারক হিসেবে সাধারণ মানুষ ও পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। একই সঙ্গে অবিভক্ত বাংলার প্রথম যে কালেক্টরেট ভবনের পাশে এ সূর্যঘড়িটি, সেই কালেক্টরেট ভবনটিও সংস্কার করে সংরক্ষণ অহংকারের অলংকার রক্ষার প্রশংসনীয় উদ্যোগ হিসেবে মূল্যায়িত হবে।
ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনের ওপর আঁধার নয়, সূর্যের আলোয় আলোকিত হোক এই সূর্যঘড়ি। কিছু মানুষের লোভ, অবিবেচনা, অবহেলার শিকার হয়ে এ ধরনের নিদর্শন যেন কালের গহ্বরে হারিয়ে না যায়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সক্রিয় হোন।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী