বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগ কতটা প্রাসঙ্গিক? ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর প্রায় এক বছর আওয়ামী লীগের নামনিশানা ছিল না। কোথাও জয় বাংলা স্লোগান শোনা যায়নি। তখন আওয়ামী লীগ নামে কোনো দলই ছিল না। বাকশালের মধ্যে আগেই আওয়ামী লীগ হারিয়ে গিয়েছিল। পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাকশালের মৃত্যু ঘটেছিল নীরবে। ও নিয়ে আর কেউ উচ্চবাচ্য করেনি। দেশের প্রথম পার্লামেন্ট জীবিত ছিল। আবদুল মালেক উকিল স্পিকার ছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের নাম ছিল অনুচ্চারিত। বড় মাপের নেতাদের ঠিকানা হয়েছিল লাল দালান। এমপিদের বেশির ভাগই ছিলেন বহাল তবিয়তে। মার্শাল ল জারি হওয়ার আগপর্যন্ত কোনো দলই নিষিদ্ধ হয়নি। সেসব দলের মধ্যে এমন অনেক দল ছিল যারা ছিল শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের জানের দুশমন। তাদের সাংগঠনিক ভিত্তিও দুর্বল ছিল না। তা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সাধারণ কর্মীরা- ঘরবাড়ি ছেড়ে পালায়নি। আবার এমন কোনো অ্যাক্টিভিটিও তাদের ছিল না, যা রাজনৈতিক সমাজে উদ্বেগ তৈরি করতে পারে।
এদিক থেকে দেখলে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে ইন্ডিয়া চলে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলো বহু গুণে বেশি বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। গ্রামের ওয়ার্ড লেভেলের খুচরা নেতাটিও নিজের এলাকায় থাকার সাহস করেননি। অনেকের বাড়িঘর ভাঙচুর হয়েছে। ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ অবৈধ ঘোষিত না হলেও তার কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ। দলটির ইলেকশনে আসারও কোনো সুযোগ নেই। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের হালফিল রাজনীতিতে দলটি একেবারে অনুল্লেখ্য হয়ে যেতে পারত। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সেটা হয়েছে কি? সরল সত্য হলো, হয়নি। কেন হয়নি? আওয়ামী লীগ ঘন ঘন ঝটিকা মিছিল করছে; এই কারণে? তা বোধ হয় নয়। দেশ ও বিদেশে থাকা আওয়ামী লীগের সমর্থকরা ফেসবুকে খুব অ্যাকটিভ- সেটাও কিন্তু বড় কোনো কারণ নয়। গণতান্ত্রিক বিশ্ব কোনো দল নিষিদ্ধ করার পক্ষপাতী নয়। বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা এ বিষয়ে সরকারের কাছে চিঠি দিয়েছে। এটাকে কেউ কেউ আন্তর্জাতিক চাপ বলছেন। রাজনীতিতে এসবের কিছু না কিছু ইম্পপেক্ট তো আছেই। কিন্তু এই পন্থায় দলটি চলমান রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সহসা স্বরূপে ফিরে আসবে, আওয়ামী লীগের কোনো ডাইহার্ড সমর্থকও এমনটি বিশ্বাস করেন বলে মনে হয় না।
এ হলো বাস্তবতার একটা দিক। আরেকটা দিক হচ্ছে, বর্তমান রাজনৈতিক সমাজের কোনো কোনো মহলের চিন্তা কিংবা দুশ্চিন্তার হয়ে রয়েছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসিত করার চক্রান্ত হচ্ছে, এ ধরনের নালিশ হরদম উচ্চারিত হচ্ছে। এ নিয়ে পারস্পরিক দোষারোপও কম হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে এনসিপি। নবীন দলটি পতিত আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করতে চায় বলে কিছু দিন আগে পর্যন্ত বিএনপিকে দোষারোপ করেছে। এখন এনসিপি একই অভিযোগের আঙুল তুলছে জামায়াতে ইসলামীর দিকে। জেনারেল ইলেকশন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ইস্যু নতুন ডাইমেনশন পেয়েছে।
উল্লেখ্য বিএনপির একটা ভোটব্যাংক রয়েছে। এরা যে কোনো পরিস্থিতিতে ধানের শীষে ভোট দেয়। আওয়ামী লীগেরও একটা ভোটব্যাংক রয়েছে। সংখ্যার হিসাবে উনিশ-বিশ। জামায়াতে ইসলামীরও ভোটব্যাংক আছে। তুলনায় ছোট। কিন্তু আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় জামায়াতের ভোট অনেকটাই বেড়েছে বলে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা। সাংগঠনিকভাবে দলটি বেশ এগিয়েছে। আওয়ামী লীগ যখন ইলেকশনে নেই তখন নৌকার বাঁধা ভোটগুলো কোন দিকে যাবে? এই ভোটব্যাংকের দিকে নজর বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী উভয়ের। আওয়ামী লীগের তৃণমূলের ভোট টানতে জামায়াতে ইসলামীর কৌশল এনসিপিকে দৃশ্যত চিন্তায় ফেলেছে। তরুণদের এই দলের নেত্রী সামান্তা শারমিনের বক্তব্য থেকে সেরকম ধারণাই পাওয়া যায়। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই নেত্রী বলেন, জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগের ফিরে আসার পথ তৈরি হবে।
এ ব্যাপারে তিনি দুই ধরনের কথা বলেছেন। এমন দুটি তত্ত্ব তিনি দিয়েছেন যা পরস্পরবিরোধী। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর রাষ্ট্রকল্প অভিন্ন। জামায়াতে ইসলামী আওয়ামী লীগের লোকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলছে, আমরা ক্ষমতায় গেলে আপনাদের কোনো ভয় নেই। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের নীরব ভোটারদের টেনে নির্বাচনি বৈতরণি পার হওয়ার কৌশল করছে। আশঙ্কার এটা হলো এক নম্বর কারণ।
আওয়ামী লীগও নাকি চায় জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় যাক। জামায়াত সরকার গঠন করলে অপপ্রচার চালাতে আওয়ামী লীগের সুবিধা হবে। আন্তর্জাতিক সমাজকে তখন তারা বলবে, বাংলাদেশে ইসলামি মৌলবাদ কায়েম হয়েছে। তখন আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসিত করতে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়বে। এগুলো কষ্ট-কল্পনা। কিছুটা কৌতুকপ্রদও বটে। আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর রাষ্ট্রকল্প একই রকম- এ ধরনের বক্তব্য রাজনীতির বাজারে সেল করা কঠিন। আসলে এনসিপির পক্ষ থেকে জামায়াত সম্পর্কে এ ধরনের বক্তব্য দেওয়ার অন্য কোনো তাৎপর্য থাকা বিচিত্র নয়। হয়তো রয়েছে এ দুটি দলের মধ্যে গভীরতর সম্পর্কের রসায়ন। সে প্রসঙ্গেও আমরা কথা বলব।
তার আগে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর ইলেকশন স্ট্র্যাটেজি নিয়ে দুয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন মনে করি। জাতীয় ঐকমত্য ও জুলাই সনদ প্রশ্নে পূর্বাপর বিএনপি পালন করেছে সংযমী ও সাবধানি ভূমিকা। দলটি কোনো হঠকারিতাকে প্রশ্রয় দেয়নি। নির্বাচিত সরকার ছাড়াই খোলনলচে পাল্টে দেওয়ার চেষ্টাও রুখে দিয়েছে বিএনপি। মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ও মর্যাদার প্রশ্নেও বিএনপি আপসহীন থেকেছে। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি ও মিত্র দলগুলো আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে সোচ্চার। পক্ষান্তরে বিএনপি নির্বাহী আদেশে কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার পক্ষপাতী ছিল না। আদালত কোনো দলকে দোষী সাব্যস্ত করে নিষিদ্ধ করলে সে ভিন্ন কথা। এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী ঘরানার ভোট বিএনপির বাক্সে পড়া উচিত। কিন্তু সবকিছুর আগে তারা চাইবেন নিজের ও তার পরিবারের নিরাপত্তা। আওয়ামী লীগের দুর্বলতা আছে- এমন ভোটারদের মনে একটা ইনসিকিউরিটি ফিলিংস কাজ করা বিচিত্র নয়। ৫ আগস্টের পর এই শ্রেণিটির অনেকে, অনেক পরিবার পাড়া-মহল্লার চাঁদাবাজ ও ধান্দাবাজদের হয়রানির শিকার হয়েছে। কেউ কেউ শিকার হয়েছেন চাঁদাবাজির। গ্রামের ব্যবসাকেন্দ্রগুলো থেকে আওয়ামী লীগের গ্রাসরুট ব্যবসায়ীদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, যদিও তারা কখনো আওয়ামী লীগের অ্যাক্টিভিস্ট ছিলেন না। আমি এমন দুয়েকটি গ্রামের খবর জানি যেখানে অতীতে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছেন বলে টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডও কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে প্রান্তিক আওয়ামী সমর্থকদের জন্য এ সময়ে নিরাপত্তা ইস্যুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যারা এই খারাপ কাজগুলো করেছে গ্রামে তাদের রাজনৈতিক দলীয় পরিচয় রয়েছে। এরা এতটাই প্রান্তিক বাঁশের কঞ্চি, এদের বিরুদ্ধে কোনো দল চাইলেও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে পারে না। ন্যাড়ার মাথার চুলের ঝুঁটি ধরা যায় না। তবে ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ের নেতারা চাইলে পল্লি প্রান্তের দুষ্ট সমর্থকদের নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারেন।
নিজেদের ইনসিকিউরড ভাবছেন- এমন ভোটারের সংখ্যা নেহাত কম নয়। প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় তারা আছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। ফেব্রুয়ারির সাধারণ নির্বাচনে নির্ভয়ে ভোট দেওয়ার পরিবেশ তৈরি হলে এই শ্রেণিটিও কেন্দ্রে যাবে। তারা সেই প্রার্থীকেই ভোট দেবেন, যে প্রার্থী নির্বাচিত হলে তাদের ব্যবসাবাণিজ্য করতে অসুবিধা হবে না। আর যাদের তারা ভয় পান, তাদের সমর্থিত প্রার্থীকে, আর যা-ই হোক ভোট দেবেন না। সামান্তা শারমিন যেমনটা বলেছেন, জামায়াতে ইসলামী যদি সত্যিই সেরকম কৌশল করে থাকে, তাহলে ভোটের কারবারে দলটি লাভবান হবে। পক্ষান্তরে যারা নির্বিবাদী আওয়ামী লীগের ভোটের প্রয়োজন নেই মনে করবে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা। সেই ক্ষতির পারদ কোন মাত্রা স্পর্শ করবে, তা বোঝা যাবে ভোটের ফল বেরোলে।
অবাধ, নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হলে রাজনীতিও হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক। গণতন্ত্রের এই জমিন থেকে তারাই ভালো ফসল মাড়াতে পারবে, যারা অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির ব্যাকরণ জেনে ঠিক জায়গায় ঠিক সময়ে তা প্রয়োগ করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ও দায়িত্বশীল দল হিসেবে বিএনপিকেও সতর্ক হতে হবে।
বলছিলাম এনসিপি ও জামায়াতের সম্পর্কের রসায়নের কথা। সাম্প্রতিককালে দল দুটোর মধ্যে একটা মিঠেকড়া ঝগড়া হচ্ছে। পিতার ভূমিকায় সন্তানকে নসিহত করা হচ্ছে। জামায়াতকে আওয়ামী লীগের আত্মীয় বলা হচ্ছে। এতে দুটো লাভ; শত্রুতার অভিনয়টাও হলো আবার আওয়ামী ঘরানার কাছে দাঁড়িপাল্লার ক্যাম্পেইনও হয়ে গেল। তথ্যাভিজ্ঞ মহলের অনেকে মনে করেন, এনসিপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক আদর্শগত। জুলাই ঘোষণার পর জামায়াতে ইসলামী বলেছিল এই ঘোষণায় ৪৭-এর প্রসঙ্গ অনুপস্থিত। এটা ঘোষণার অসম্পূর্ণতা। ঠিক একই কথা বলেছিল এনসিপিও। এমনই আরও অনেক বিষয় সামনে আনা যাবে যাতে নবীন ও প্রাচীন দল দুটোর সম্পর্ক সূত্র পাঠ করা সহজ হবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক