২০২৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাত ১টার দিকে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাই। সৌদিয়া বিমানের টিকিট হাতে নিয়েও যেন হালকা সংশয় কাজ করছিল, এবারের যাত্রা কতটা নির্বিঘ্ন হবে কে জানে! সন্দেহটি মিথ্যে হয়নি। বোর্ডিং কার্ড ও লাগেজ পাঠাতে অকারণে আধা ঘণ্টারও বেশি অতিরিক্ত সময় লেগে গেল। দায়িত্বে থাকা কর্মীদের অদক্ষতা ও দুর্ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। শেষে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের অধীনে ইমিগ্রেশন পার হয়ে কিছুটা স্বস্তি পেলেও পুলিশের ব্যবহার যে কতটা রুক্ষ হতে পারে, তার নমুনা তখনই প্রত্যক্ষ করলাম। আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম ‘৭ নম্বর ডিপার্চার লাউঞ্জটা কোন দিকে?’ কর্তব্যরত পুলিশ কড়াভাবে উত্তর দিলেন, ‘আমি জানি না’। যে মানুষটির প্রতিদিনের কর্মস্থানই বিমানবন্দরের লাউঞ্জ, তিনিই জানেন না ৭নং লাউঞ্জটি কোথায়? তাহলে এ দুঃখ রাখব কোথায়! শেষে এক কফির দোকানদারের দিকনির্দেশনা নিয়ে পৌঁছলাম নির্দিষ্ট লাউঞ্জে।
সেখানে নিরাপত্তা তল্লাশির এক কঠিন প্রহসন। কোমরের বেল্ট, জুতো, মানিব্যাগ- সব খুলে ট্রেতে রাখতে হলো। এমনকি আমার ডায়াবেটিসের ওষুধ নিয়েও প্রশ্ন উঠল। প্রেসক্রিপশন ও ডায়াবেটিস বিষয়ক বই দেখিয়েও সন্দেহ ঘুচল না। পরে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ডেকে আনা হলো। আমার সুপ্রিম কোর্ট ও সাংবাদিক পরিচয়ের কাগজপত্র দেখানোর পরই মুক্তি মিলল। মনে হলো, সন্দেহ নয় অসৎ উদ্দেশ্যের ছায়াই যেন সেখানে ভাসছিল। এর পরেই আরেকটি দৃশ্য আমার মনে গেঁথে গেল। একজন ভদ্রলোক, ওমরাহ পালনের জন্য এহরাম পরিহিত, তাঁর হাতব্যাগে ডায়াবেটিসের ওষুধ ছিল, কিন্তু প্রেসক্রিপশন নেই। কর্তব্যরত পুলিশদের অনমনীয়তা দেখে তিনি বারবার অনুনয় করছিলেন, কিন্তু কর্ণপাতের লক্ষণ ছিল না। শেষ পর্যন্ত তাকে আড়ালে নিয়ে যাওয়া হলো। পরবর্তীতে তাঁর সঙ্গে হয়তো কিছু দফরফা করে ওষুধ নিতে অনুমতি দিল। এহরাম পরিহিত মানুষটি বিড়বিড় করে বলছিলেন, ওমরাহর কাপড় পরিহিত অবস্থায়ও তাকে ম্যানেজ করতে টাকা দিতে হলো। সৌদিয়া বিমানে ওঠার সময় বিমানের গেটেই হ্যান্ড লাগেজে আরও এক দফা চেকিং হলো। আসন গ্রহণের পর এবার ঢাকা থেকে একটানা সাত ঘণ্টার আকাশযাত্রা। জেদ্দা বিমানবন্দরে অবতরণের পর আবারও একই নিয়মে সবকিছু ট্রেতে রেখে তল্লাশি। তবে পার্থক্যটা চোখে পড়ল আচরণে। কর্তব্যরত কর্মীদের চোখে-মুখে আন্তরিকতা এবং কথাবার্তায় সহযোগিতার সুর। আরেক ধাপ উপরে গিয়ে ৫০ নম্বর ডিপার্চার লাউঞ্জে প্রবেশের আগে আবারও পুরুষ-মহিলা আলাদা লাইনে তল্লাশি হলো। কিন্তু কোনো অসহিষ্ণুতা বা অমর্যাদা নয়, বরং ভদ্র ও আধুনিক ব্যবস্থাপনায় সবকিছু নির্বিঘ্নে অতি দ্রুত সম্পন্ন হলো। বিমানে আরোহণের ক্ষেত্রেও শৃঙ্খলার এক ব্যতিক্রমী চিত্র দেখলাম-এ বি সি ডি জোন অনুসারে চারটি সিঁড়ি দিয়ে যাত্রীদের প্রবেশ করানো হলো। কোনো ধাক্কাধাক্কি বা হুড়োহুড়ি নয়। যথাযথ সময়ে বিমান উড্ডয়ন করল। আর কাঁটায় কাঁটায় ১৪ ঘণ্টা পর আমরা পৌঁছে গেলাম ওয়াশিংটন ডিসির আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। এবার ইমিগ্রেশনের পালা। একসঙ্গে একাধিক বিমান অবতরণ করলেও যেন এক অদৃশ্য শৃঙ্খলার জাল বোনা ছিল চারদিকে। প্রায় ১০০টি কাউন্টার খোলা। হাসিমুখে কর্মীরা যাত্রীদের ‘স্যার’ সম্বোধন করে নির্দিষ্ট লাইনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন। আমাদের ভাগ্যে জুটল ৪৭ নম্বর কাউন্টার। আমি সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই অফিসার বললেন “Good evening, Sir. May I have your passport, please?” তাঁর ভদ্রতার উজ্জ্বল নমুনা যেন মুহূর্তেই আমার সঞ্চিত সব ভীতি দূর করে দিল। আমার পাসপোর্ট হাতে নিয়ে তিনি আরেকটি প্রশ্ন করলেন “Where will you stay during your stay in the USA?” আমি বললাম, “With my son.” পরের প্রশ্ন “What does your son do, Sir?” আমি ছেলের পরিচয়পত্র দেখিয়ে বললাম- “My son is a scientist under the Fedarel Government of USA in the National Cancer Institute of the National Institutes of Health.” কথাটি শুনেই অফিসার অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন “Your son is a scientist in the largest medical research laboratory in the world! You are a proud father. I congratulate you, Sir.”
কথাগুলো যেন বুকের ভেতর আনন্দের ঢেউ তুলে দিল। আমি ভেবেছিলাম কঠোর প্রশ্নোত্তরের মুখোমুখি হতে হবে, কিন্তু এর বদলে পেলাম অকৃত্রিম সম্মান। এবারে আমার স্ত্রীর পালা। আমার এখন কাউন্টার ত্যাগ করতে হবে। আমার গিন্নি ইমিগ্রেশন অফিসারের প্রশ্ন বুঝবে কি-না, সঠিকভাবে উত্তর দিতে পারবে কি-না, এই সংশয়ে আমি খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে ইমিগ্রেশন অফিসারকে বললাম, “I would like to assist my spouse since this is her first time in America and she might face some difficulties in understanding and responding in English.” আমার কথায় তিনি হেসে বললেন, “Please, you may call her, the proud mother of a scientist.” অফিসার আমার উপস্থিতিতেই আমার স্ত্রীকে হাসিমুখে বললেন “You are a proud mother, thank you very much, Madam” - কথাটা বলেই অফিসার আমার গিন্নির পাসপোর্টে অ্যান্ট্রি সিল মেরে দিলেন। তখন গিন্নির চোখেও আনন্দের দীপ্তি ঝলমল করে উঠল। মনে হলো, সন্তানের সাফল্যের আলোয় আমরাও যেন আলোকিত। ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেও আরেক দুঃসাহসিক অধ্যায় বাকি ছিল। আর সেটি হলো লাগেজ সংগ্রহ। চারটি বড় ও দুটি ছোট ব্যাগ, চারটি বড় ব্যাগের প্রতিটির ওজন কমপক্ষে ২৩ কেজি করে। অথচ ট্রলি ছাড়া এগুলো বহন করা অসম্ভব। কিন্তু আমেরিকার মতো উন্নত দেশে ট্রলি ভাড়া করতে হয় ছয় ডলার দিয়ে, আর সেটিও শুধুই মেশিনে কার্ডের মাধ্যমে। নগদ টাকা নয়, আবার মেশিন কেবল ২০ ডলারের নোট পর্যন্ত ভাঙায়, ১০০ ডলারের নোট ভাঙানোর ব্যবস্থা নেই। আমি ১০০ ডলারের নোট খুচরা করার জন্য কয়েকজন যাত্রীকে অনুরোধ করলাম কিন্তু ফল হলো না। শেষমেশ একটি একটি করে চারবার ট্রলি টেনে আনতে হলো। পরে ছেলেই ক্রেডিট কার্ড দিয়ে ট্রলি নিয়ে লাগেজগুলো অনেক দূরে তার গাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলল, আর বাসায় পৌঁছেও সে নিজেই প্রাণান্ত পরিশ্রম করে লাগেজগুলো একটি একটি করে বাসায় বয়ে নিল। আমাদের ধরতেই দিল না। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ওয়াশিংটন ডিসিতেও বিনা ভাড়ায় ট্রলির ব্যবস্থা না থাকাটা সত্যিই এক আশ্চর্য ঘটনা। আমার মনে হয়, বিশ্বের সব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেই বিনামূল্যে ট্রলি ব্যবহার করা যায়। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে নয়- এ যেন বিশ্বের “অষ্টম আশ্চর্য”! ঢাকা, জেদ্দা আর ওয়াশিংটন ডিসি- তিন ভুবন, তিন ভিন্ন মুখচ্ছবির প্রত্যক্ষ ও জ্বলন্ত সাক্ষী হলাম। কোথাও দুর্ব্যবহার, কোথাও আন্তরিকতা, কোথাও আবার সম্মান আর গৌরবের অমৃত স্পর্শ। শেষ পর্যন্ত মনে হলো, যাত্রাপথের এসব বৈপরীত্যই যেন জীবনের প্রতিচ্ছবি- আনন্দ, কষ্ট ও গ্লানির মধ্যেই আনন্দ ও গৌরবের ফুল ফোটে।
লেখক : কলামিস্ট