‘যার বিয়ে তার খবর নেই, পাড়া পড়শির ঘুম নেই।’ প্রচলিত প্রবচন দিয়েই শুরু করলাম। কথাটি এ কারণে যে বহু প্রতীক্ষিত জুলাই ঘোষণাপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছে এনসিপির স্বাক্ষর বাদ রেখেই। এটা যে হতে পারে, সে ধারণা আগে থেকেই অনেকের ছিল। থাকার কারণও অস্পষ্ট নয়। এই ঘোষণা যখন পাঠ করা হয়, তখন সমন্বয়কদের কয়েকজন এ অনুষ্ঠানের চেয়ে সমুদ্রসৈকতে অবস্থানকে ভালোবেসেছিলেন। কথা তখন থেকেই উঠেছিল, এখন আরও বড় আকারে দেখা দিয়েছে। কথা এই কারণে যে আমরা যখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ হতে যাচ্ছি, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে দৃঢ়ভাবে গভীর উচ্চারণ করছি, তখন যেসব তরুণ, যাদের গায়ে এখনো স্বৈরাচারের আঘাতের চিহ্ন, ছোপ ছোপ রক্তের দাগ লেগে আছে, তাদের না নিয়েই ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছি। বিষয়টি নিয়ে এনসিপির নেতার কথা বলেছেন। তাদের কথায় ক্ষোভ, অভিমান এবং বেদনার সুর বিদ্যমান। তাদের গড়া সরকার তাদের বাদ দিয়েই নবজন্মের বাংলাদেশের ঘোষণা দিয়েছে। এটা কতটা আগামীর মূল্যায়নে, অথবা সততার মাপকাঠিতে গ্রহণযোগ্য হবে, সে প্রশ্ন থেকেই গেল। কথা এ কারণে, যে দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আইনি ভিত্তির নিশ্চয়তা দেওয়ার আগে সনদে সই না করার সিদ্ধান্তে এনসিপির সঙ্গে আরও কয়েকটি দলের সহাবস্থান ছিল। এনসিপি মনে করেছিল, এসব দল শেষ পর্যন্ত তাদের অবস্থানে থাকবে। কিন্তু স্বাক্ষর করার দিনে ঘটে নাটকীয়তা। আগে দোদুল্যমানতা থাকলেও সেদিন সমমনা ইসলামি দলগুলো সনদে স্বাক্ষর করে। এই স্বাক্ষরকে এনসিপি রাজনৈতিক প্রতারণা বলেছে। এ নিয়ে আলোচনায় যাব না। এরশাদের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের সময় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। বিএনপির সঙ্গে যারা আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ ছিল, তাদের অনেকেই শেষ রাতে নির্বাচনে গিয়েছিল। রাজনৈতিক অঙ্গনে তাদের পরিণতিও ইতিহাসে নির্ধারিত রয়েছে। এরা গাদ্দার না গণতান্ত্রিক সে প্রশ্ন ইতিহাসে এখনো ঝুলছে। সোজা কথায় গায়ে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ নিয়ে নাহিদ ইসলাম আরও আগে যে বলেছিলেন বিপ্লব ছিনতাই হয়ে গেছে, এটি হয়তো তার নমুনা হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে।
জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, জুলাই সনদের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশের সূচনা হয়েছে যা আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও সমৃদ্ধির পথে জাতিকে এগিয়ে নেবে এবং গত ১৬ বছরের নৃশংসতার অবসান ঘটাবে। তিনি বলেছেন, ‘আজ আমাদের নতুন জন্মের দিন।’ এই স্বাক্ষরের মধ্য দিয়েই আমরা নতুন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা করেছি। কথা ও বাস্তবতার সঙ্গে মেলালে এ কথা বলতেই হবে, যারা এ সনদ স্বাক্ষর করেছেন, তারা প্রস্তাবিত নতুন বাংলাদেশের যাত্রী। এ বিবেচনায় এনসিপি নতুন পথের যাত্রী বিবেচিত না হলে সংগত প্রশ্ন ওঠে এরা কারা? এ কথা খারাপ শোনা গেলেও এটাই সত্যি যে এসব সংগঠকদের বয়স কত, তাদের নেতৃত্ব কে দিয়েছে, কে তাদের মাস্টারমাইন্ড অথবা এই নিয়ে সব কথা বাদ দিয়ে এ কথা তো সবাই স্বীকার করবেন যে এসব তরুণ নিজের জীবনের চেয়ে ফ্যাসিবাদ হটানোকে অধিকতর গুরুত্বের এবং জরুরি বিবেচনা করেছিল বলেই, আজ যারা গর্ব করে নতুন বাংলাদেশের জন্মের কথা বলছেন, তারা এ জায়গায় আছেন। আজ অনেক কথা হচ্ছে হয়তো আরও হবে। সে কথা থাক। সত্য তো এটাই যে ১৫ বছর বা তারও অধিক সময় আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেও তাকে হটানো যায়নি। হটানো যাবে, সে আশাও অনেকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। বলা যায় এক অসম্ভবকে সম্ভব, কল্পনাকে সত্যে পরিণত করেছে যে তরুণরা, তাদের দল এনসিপি। শুধু তাদের কথাই নয় আমরা আরও একবার ইতিহাসের আশ্রয়ী হই। মনে করুন ১৯৭১ সালের সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা, যেদিন দেশের স্বাধীনতার জন্য, দেশের ইজ্জত রক্ষার জন্য, দেশের আপামর জনতা নিজেদের জীবনের চেয়ে দেশের স্বাধীনতাকে অগ্রগণ্য বিবেচনা করেছিল। রাজনৈতিক মূল্যায়ন যা-ই হোক এ মানুষগুলোর দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধও ছিনতাই হয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানকে বলা হয়েছিল পাকিস্তানের চর। সে অনেক কথা। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার নামটি পর্যন্ত নেওয়া যেত না। কেন এবং কীভাবে মুক্তিযুদ্ধ ছিনতাই হয়েছিল তা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। আসলে বিষয়টি সময়ের আলোকে দেখলে বলা যায়, যে মহল ঘাপটি মেরে থাকে, সময়ে মুখে কুলুপ আঁটে তারা বিদেশি ষড়যন্ত্রে সুযোগ বুঝে মুখোশ উন্মোচন করে। আশপাশের দুই-একটি দেশের নমুনা তুলে ধরে অনেকে বলেন, বিপ্লবপরবর্তী বিপ্লবী শক্তির ক্ষমতা গ্রহণের কারণে বাংলাদেশে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। অথচ ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর মনে করা হয়েছিল প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষমতায় না থাকাতেই মুক্তিযুদ্ধ বিকৃত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। বোধ করি এ কথা এবারে বলা যায়, বিপ্লব পরবর্তী দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ায় নানা উপাদানের সংমিশ্রণ ঘটেছে। মূলত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই মূল কথা। সেদিকে না গিয়ে কারা এর মধ্যে সংস্কার এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ ঢুকিয়েছে, সে কথা এনসিপি থেকে, সম্প্রতি বলা হয়েছে। নাহিদ ইসলাম তার এক পোস্টে বলেছেন, ...কখনোই সংস্কারমূলক আলোচনায় অংশ নেননি, না জুলাই অভ্যুত্থানের আগে, না পরে। তারা কখনোই গঠনমূলক প্রস্তাব দেয়নি, কোনো সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেনি কিংবা একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়নি, তাদের ভাষায় হঠাৎ করে সংস্কার কাজে অংশ নেওয়া একটি রাজনৈতিক অনুপ্রবেশ। সংস্কারের ছদ্মবেশে রাজনৈতিক নাশকতা। জুলাই ঘোষণাপত্র স্বাক্ষরের আগে অসংলগ্ন যে প্রতিবাদ হয়েছিল সে সম্পর্কেও তারা তাদের মতামত প্রকাশ করেছেন। এখন বিবেচনার বিষয় হচ্ছে, যারা মূল আন্দোলন নিয়ে কথা বলছেন, তারা সঠিক না যারা এখন কথা বলছেন তারা সঠিক?
আমরা একটি ফ্যাসিবাদ মুক্ত বাংলাদেশ গঠনে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়ার জন্য লড়াই করছি। ফ্যাসিবাদমুক্ত হতে গিয়ে আমরা যারা এখন কথা বলছি তারা আসলে নিজেরাই নানা জটিলতায় জড়িয়ে পড়েছি। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আমরা নির্বাচনের কথা বলছি, যে ঐক্যের সুর বাজালাম সেই সুর নিয়ে সবাই আমরা নির্বাচনে যাব। ঐক্যের সুর নিয়ে সবাই নির্বাচনের দিকে যাওয়ার এই আশাবাদ মূলত গোটা জাতির প্রত্যাশার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। একটি নির্বাচনের জন্য মুখিয়ে আছে জাতি। তিনি যে ঐক্যের কথা বলেছেন, সেটি কিন্তু আগের জায়গায় নেই। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন প্রশ্নে দ্বিমুখী ভাব প্রকাশ হচ্ছে। নানা পথ পদ্ধতির কথা বলে কার্যত ঐক্যের অটুটতার কথা বলা হচ্ছে না। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ফ্যাসিবাদ অপসারণে তরুণরাই শেষ পর্যন্ত মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। তাদের এই ভূমিকাকে অবমূল্যায়ন করার সুযোগ নেই। জুলাই সনদে তাদের স্বাক্ষর না থাকা মূলত তাদের ভিন্নতার কথাই প্রকাশ করে। একটি ফ্যাসিবাদের বিকল্প আরেকটি ফ্যাসিবাদ নয়। গণতন্ত্রের মুক্তির লক্ষ্যে যে ম্যাগনাকার্টা রচিত হওয়া দরকার সেখানে আন্দোলনের মুখ্য ভূমিকা পালনকারীদের অংশগ্রহণ ও স্বতঃস্ফূর্ততা নিশ্চিত করা না গেলে মূল লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। যেহেতু এনসিপি সনদের ব্যাপারে আগে থেকেই ভিন্ন মত প্রকাশ করে আসছিল, সে কারণে তাদের মতের সম্মিলন ঘটানো জরুরি ছিল। যত কথাই হোক, নাহিদ ইসলামরা যদি ঐকমত্য পোষণ না করেন, তাহলে সে সনদ জাতীয় ঐক্য ধারণে বা ফ্যাসিবাদ নির্মূলে কার্যকর হবে সে কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। আমরা যদি আবু সাঈদদের রক্তের কথা ভুলে যাই, তাহলে সেটা আর যাই হোক ফ্যাসিবাদ উচ্ছেদের আন্দোলনের প্রতি আনুগত্যের পরিচায়ক নয়। যারা এনসিপি ছাড়া সনদে স্বাক্ষর করছেন, তাদের কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, সেটি তাদের ব্যাপার। তবে এ কথা মনে রাখতে হবে, একটি নতুন প্রজন্ম, যাদের অনেকেই নাবালক ছিল, যারা প্রাইমারি মাধ্যমিকের ছাত্র ছিল এখনো তারা ছাত্র রয়েছে। বিপ্লব-পরবর্তী কীভাবে এই ছেলেগুলো সড়ক নিয়ন্ত্রণসহ সারা দেশ বিশেষ করে রাজধানী নিয়ন্ত্রণ করেছে তা জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। নাহিদ ইসলামের ভাষায় যদি বিপ্লব ছিনতাই ঐক্যবদ্ধভাবে হয়ে থাকে, তাহলে তা ফ্যাসিবাদের পক্ষেই যাবে। একটি ফ্যাসিবাদমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে সবাই রাজনৈতিক মাঠে থাকবেন এটাই প্রত্যাশা। নয়তো নতুন যাত্রা হবে কালো দাগে চিহ্নিত।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট