ধান-চাল উৎপাদনে বৃহত্তর জেলা নওগাঁ। পুরো বোরো মৌসুম জুড়ে বৃষ্টি-বাদল, বন্যা আর ব্লাষ্ট রোগের আক্রমণ ছিল এ জেলাতেও।
কৃষকরা বলছেন, এসব কারণে গত কয়েক মৌসুমের চেয়ে এ মৌসুমে ধানের ফলন কম হয়েছে বিঘা প্রতি প্রায় ৬ থেকে ৭ মণ পর্যন্ত।
আর এতে স্থানীয় বাজারগুলোতে ধানের দাম উঠেছে গত মৌসুমের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
এদিকে মিলাররা বলছেন, ধান কিনতে হচ্ছে চড়া দামে তাই উৎপাদন খরচ দিয়ে বিক্রিও করতে হচ্ছে বেশি দাম দিয়েই। কোন কোন মিল মালিকের মতে, রমজানের ঈদের পর চালের দাম বাড়বে আরও বেশি। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নজরদারির কথা বলা হলেও প্রতিশ্রুতির সাথে বাস্তবের কোন মিল নেই।
সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় নওগাঁর রানীনগর উপজেলার আবাদপুকার হাটে ধান বিক্রি করতে আসা ওই উপজেলার কৃষক আব্দুস ছালামের সাথে। তিনি বলেন, মিনিকেট জাতের ২৬ মন ধান প্রতি মণ ১ হাজার ১১০ টাকা দামে বিক্রি করেছেন। কিন্তু খুব যে বেশি লাভ হয়েছে তা নয়।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, গত বোরো মৌসুমে তিনি ধান পেয়েছিলেন প্রতি বিঘায় প্রায় ২৩ থেকে ২৪ মণ হারে। কিন্তু সেই জমিতে এবার ফলন হয়েছে ১৬ থেকে ১৭ মণ হারে। আবার গতবার যেখানে ধান কাটতে প্রতি বিঘায় দিতে হয়েছে দেড় থেকে ২ হাজার টাকা করে। সেখানে এ বছর পানিতে ধান পড়ে যাওয়ার কারনে শ্রমিকদের দিতে হয়েছে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।
কৃষক সালামের মতে, এ বছর প্রতি মণ ধান উৎপাদন করতে তার খরচ পড়েছে প্রায় সাড়ে ৯’শ টাকা পর্যন্ত। যা বিক্রি করছেন ১ হাজার ১১০ টাকা দামে।
এছাড়া ওই একই উপজেলার ধান বিক্রি করতে আসা কৃষক আনিছুর রহমান জানান, নাজিরশাইল জাতের ১১ মণ ধান তিনি বিক্রি করেছেন সাড়ে ১২’শ টাকা মণ হিসেবে। তার ধানের দাম একটু বেশি হওয়ার কারণ তিনি জানান, অন্যান্য ধানগুলোর বেশির ভাগই পানিতে ডুবে গেলেও তার ধানগুলো তুলনামুলক অনেক ভাল ছিল। আর তাই ধানের রং ও গুনগত মানের কারনে তিনি ধানের দাম একটু বেশি পেয়েছেন।
তবে তাদের মতে, ধান রোপনের পর থেকে ঘরে উঠা পর্যন্ত কৃষকদের যে পরিমাণ দুশ্চিন্তা আর পরিশ্রম করতে হয় তার তুলনায় এ লাভ কিছুই নয়। তাদের অভিযোগ, মুনাফার একটা বড় অংশই চলে যায় মিল মালিক আর সিন্ডিকেটদের পকেটে।
এদিকে বাজারে চালের চড়া দামের পিছনে মিল মালিকরা বলছেন, ধানের দাম বেশি হওয়ার কারনে তাদের ধান কিনতে হচ্ছে অনেক বেশি রেটে। আর তাই উৎপাদন, প্যাকিং আর পরিবহন খরচ মিলিয়ে তাদের চাল বিক্রি করতে হচ্ছে অনেক বেশি দামে।
এ বিষয়ে কথা হয় মফিজ উদ্দিন অটোমেটিক রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী তৌফিকুল ইসলামের সাথে তিনি জানান, জেলার আবাদপুকুর ও মাতাজিহাট থেকে মূলত ধান কিনেন তিনি। আবাদপুকুর হাট থেকে নাজিরশাইল জাতের প্রতি মণ ধান ১১’শ ৩০ টাকায় ধান ক্রয়ের পর পরিবহন খরচ বাবদ প্রতি বস্তায় তাকে দিতে হয় ১০ টাকা। এর সাথে যুক্ত হয় উৎপাদন খরচ ও প্যাকিং মিলে প্রায় ৫০ টাকা। সব কিছু মিলিয়ে তার রাইস মিল থেকে প্রতি ৫০ কেজির নাজিরশাইল জাতের চাল বিক্রি করছেন ২৬’শ টাকায়।
তারপরও তার দাবি এই দামে বিক্রি করেও লোকসান গুণতে হচ্ছে তাকে। তবে এ কথা মানতে নারাজ ফারিহা রাইস মিলের সত্ত্বাধিকারী শেখ ফরিদ উদ্দিন। তিনি লাভের কথা অকপটে স্বীকার করে বলেন, কিছু মিলার লাভের কথা ঢাকতে গিয়ে হরহামেশায় মিথ্যা কথা বলেন। কারণ মৌসুমের শুরু থেকেই কাঙ্খিত লাভেই চাল বাজারজাত করছেন মিলাররা। অটোমিলের ক্ষেত্রে এ লাভের পরিমাণ আরও বেশি বলে জানান তিনি।
এখানেই শেষ নয়; খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে নওগাঁর খুচরা বাজারে নাজিরশাইল জাতের চাল প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৪ থেকে ৫৫ টাকা কেজি। এছাড়া মোটা চাল প্রতি কেজি ৪৬ থেকে ৪৭, বিআর-২৮ জাতের চাল ৪৮ থেকে ৪৯, জিরা ৫০, মিনিকেট ৫২ থেকে ৫৩, কাটারিভোগ ৫৭ থেকে ৫৮ ও আতপ চাল প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা কেজি।
এ বিষয়ে নওগাঁ শহিদ নূরুন্নবী পৌর মার্কেটের খুচরা চাল বিক্রেতা সঞ্জিত কুমার ঘোষ জানান, সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতিটি চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৩ থেকে ৪ টাকা পর্যন্ত। ঈদের আগে এর দাম আরো বাড়তে পারে।
একই বাজারের মোবারক হোসেন নামে আরেক চাল বিক্রেতা বলেন, মিলগুলো থেকে যথেষ্ঠ পরিমাণ চাল পাচ্ছেন না তারা। তাই অনেক ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী চাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।
চাল কিনতে আসা দর্জি আলতাফ হোসেন বলেন, প্রতি রমজানে এমনিতেই প্রতিটি দ্রব্যমূল্যের দাম বেশি থাকে। তার উপর এবার চালের উচ্চমূল্য। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের মত নিম্নআয়ের মানুষের জন্য এ দামে চাল কিনে খাওয়া প্রতিদিনই দূরহ হয়ে পড়ছে।
শহরের বড় বাজার চাল পট্টিতে চাল কিনতে আসা রিকশা চালক আরব আলী বলেন, প্রতিদিন রিকশা চালিয়ে যা আয় হয় তার সিংহভাগই চলে যায় চাল কিনতে। অন্য কিছু কেনার মত তার আর অবশিষ্ট থাকে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে আর কিছুদিন পর আমাদের কষ্টের সীমা থাকবে না। বরাবরই সিন্ডিকেট আর মজুদের বিপক্ষে অবস্থান সরকারের। কিন্তু এ নিয়ে কার্যত কোন পদক্ষেপ দেখা যায় না নওগাঁয়। বাজার মনিটরিং এর কথা বলা হলেও তা সীমাবদ্ধ থাকে।
এ বিষয়ে নওগাঁর জেলা প্রশাসক ড. মো. আমিনুরের সাথে কথা বলা হলে তিনি বলেন, চাল মজুদের কোন সুযোগ নেই। জেলা প্রশাসনের অব্যাহত নজরদারি রয়েছে। যে কেউ ইচ্ছে করলে চালের দাম বা মজুদ বৃদ্ধি করতে পারবে না।
বিডি প্রতিদিন/ ১৯ জুন,২০১৭/ ই জাহান