এক সময় বহতা নদী ছিলো। এখন হয়ে গেলো ড্রেন। আর এই সুযোগে ইচ্ছেমত দখল শুরু করে বিভিন্ন আকারের ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। কোথাও কোথাও আবার নদীর মধ্যেই সীমানা প্রাচীর দিয়ে দখল করে ভবন তৈরি হচ্ছে। ইচ্ছেমত দখল ও দূষণে মরে গেছে করতোয়া নদী। ঢেউ নেই, পানি নেই, পাড় নেই। এসবের বদলে আছে নদীর পাড়ে সুউচ্চ ভবন, বাড়িঘর, অবৈধ স্থাপনা, নদীর বুকে ময়লা আর শহরের বর্জ্য নদীতে ফেলার ড্রেনেজ ব্যবস্থা। পানি দূষিত হওয়ার কারণে মাছ নেই। নদীকে আর নদী বলে মনে হয় না। যেন শহরের সবচেয়ে বড় ড্রেন বলে মনে হয়। নদী বাঁচাতে জেলা প্রশাসন থেকে দখলদারের একটি তালিকা করলেও আবারো গড়ে উঠছে ভবন।
জানা যায়, প্রায় ১৮০ কিলোমিটার করতোয়া নদীর তীর ঘেঁষে প্রাচীন পুন্ড্রনগরীর গোড়াপত্তন হলেও সেই সভ্যতার সঙ্গে এখন করতোয়াও ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিতে চলেছে। করতোয়া নদী বগুড়া শহরের বুক চিরে প্রবাহিত হয়ে জেলার শেরপুর উপজেলার চান্দাইকোনায় বাঙালি নদীতে গিয়ে মিলেছে। উৎপত্তিস্থল থেকে এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮০ কিলোমিটার।
এর মধ্যে দূষণ, দখল, ভরাট, পানি প্রবাহ না থাকায় এখন মরা নদী হিসেবে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৮৮ সালে বন্যার সময় তৎকালীন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশে গাইবান্ধার গোাবিন্দগঞ্জ উপজেলা সদরের খুলশিচাঁদপুর এলাকায় বাঁধ ও স্লুইস গেট নির্মাণের মাধ্যমে করতোয়া নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা হয়।
সে সময় ওই অংশে করতোয়ার মূল স্রোত একটি শাখা নদীর মাধ্যমে বাঙালি নদীর সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এতে গোবিন্দগঞ্জ থেকে বগুড়ার দিকে করতোয়া নদীর প্রবাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে দিনে দিনে সরু খালে পরিণত হয়। একদিকে পানি শুন্যতায় প্রবাহ বন্ধ, অন্যদিকে ভরাট আর দখলের ফলে নদীটি এখন মৃত।
করতোয়া নদীটি শহরের ভেতরের অংশে যে যেখানে পেরেছে দখল ও ভবন নির্মাণ করেছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনেই দখল করে নদীর ভেতরে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এদিকে শুষ্ক মৌসুম আসার আগেই করতোয়া নদীতে এখন পানি শুন্য। দুএকটি স্থানে পানি দেখা গেলেও শহর ও শহরতলীর প্রায় ২০ কিলোমিটারে শুধু ড্রেনের কালো পানি বয়ে যাচ্ছে। দখল করা নদীর তীরে নির্মিত হয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা।
বগুড়া শহরের নদী পাড়ের বাসিন্দারা জানান, নদীর পাড় দখল হয়ে আছে স্বাধীনতার আগে থেকেই। কেউ ড্রেন করেছে। কেউ করেছে বাড়ি। এছাড়া বগুড়া পৌরসভার বড় বড় ড্রেনেজ ব্যবস্থাও করা হয়েছে করতোয়া নদীতে। এ কারণে শহর এলাকার এই নদীতে আর মাছ পাওয়া যায় না।
বগুড়া শহরের বউবাজার এলাকার বাসিন্দা আব্দুল আজিজ জানান, করতোয়া নদী দখল হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রশাসন থেকে মাঝে কয়েকবার উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হলেও পরে আবারো অনেকেই সেই স্থানে অস্থায়ীভাবে ঘর উঠেছে। নদীতে বর্ষা মৌসুম বা বন্যার সময় ছাড়া পানি দেখা যায় না। নদীর তলায় এখন ড্রেনের কালো পানি দেখা যায়। নদী না বলে শহরের সবচেয়ে বড় ড্রেন এখন করতোয়া নদী। নদী থেকে প্রতিদিন দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
বগুড়া শহরের বড়গোলা এলাকার বাসিন্দা আব্দুল সালাম জানান, তিনি এক সময় নদীতে নৌকা চলতে দেখেছেন। নদীতে মাছ ছিলো। এখন সেই নদীতে মাছ তো দূরের কথা। পানির দিকে তাকানো যায় না। বর্ষাকালে কিছু সময় পানি দেখা গেলেও সেটিও খুব বেশি দিন স্থায়ী হয় না। বৃষ্টিপাত কম হলেই আবারো নদীর পানি কালো হয়ে যায়। শহরের বেশিরভাগ ড্রেন নদীতে সংযুক্ত করা হয়েছে। নদীর পাড়ে বাড়ি-ঘর নির্মাণ করা হয়েছে।
বগুড়া শহরে মালতীনগরের খলিলুর রহমান জানান, নদীর পানি বাড়িঘরের উচ্ছিষ্টে ভরা। কালো-নোংরা পানি। দখল করে ঘর-বাড়ি করার কারণে নদীর অবস্থা খুবই করুণ। নদীকে আর নদী বলে মনে হয় না।
বগুড়া জেলা প্রশাসনের রাজস্ব শাখা সূত্র জানায়, শহরের মধ্যে করতোয়া নদীর কয়েকটি স্থানে দখল হয়েছে। নদী দখল হয়ে যাওয়া স্থানে বাড়িঘর, ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে দখল হওয়া জমির পরিমাণ সাড়ে পাঁচ একর। করতোয়া নদী দখলের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সর্বশেষ বেশ কয়েকজন দখলদারের নামের তালিকা তৈরি করা হয়। জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, সব মিলিয়ে দখলের পরিমাণ সাড়ে পাঁচ একর। গত ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। আবারো অভিযান চলবে। নদীর স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনতে কিছু পরিকল্পনাও নেওয়া হচ্ছে।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান জানান, করতোয়া নদীর প্রাণ ফেরাতে একটি প্রস্তাবনা প্রদান করা হয়েছে। বগুড়ার করতোয়া নদীর পাড় দখলকারীদের বিরুদ্ধে প্রথম ধাপে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এবার দ্বিতীয় ধাপে উচ্ছেদ চালানো হবে খুব দ্রুত।
বিডি প্রতিদিন/আল আমীন