নারী উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা খাতে অসামান্য অবদান রেখেছেন টিএমএসএসের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপিকা ড. হোসনে আরা বেগম। গরিব ও অসহায় মানুষকে নানাভাবে সহায়তা প্রদান অব্যাহত রেখেছেন। এ পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠান থেকে ২২ লাখ পরিবার সুফল পেয়েছে
ইচ্ছাশক্তি আর একাগ্রতা মানুষকে শিখরে পৌঁছে দিতে পারে। ন্যায়নীতি আর সততাকে সঙ্গী করে আলোর মুখ দেখানো মানুষের নাম অধ্যাপিকা ড. হোসনে আরা বেগম। ব্যক্তিজীবনে তিনি প্রথমে ছিলেন পুরুষ; পরে নারীতে রূপান্তরিত হন। ভিক্ষা আর মুষ্টির চালে ভিক্ষুকদের গড়া সংগঠন টিএমএসএস এখন বিভিন্ন দেশে উন্নয়নের সুনাম ছড়িয়েছে। গত ৪৮ বছরে ৫০ হাজার মানুষকে আয়ের মুখ দেখিয়েছেন টিএমএসসের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপিকা ড. হোসনে আরা বেগম। তিনি উত্তরাঞ্চলের মানুষকে সহজে সেবা দিতে স্থাপন করেছেন ১ হাজার শয্যাবিশিষ্ট টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ ও রফাতউল্লাহ কমিউনিটি হাসপাতাল। ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হার্ট সেন্টার। ২৫০ শয্যা নিয়ে চালু করা হয়েছে ক্যান্সার হাসপাতাল। হাসপাতালের পাশেই স্থাপন করা হয়েছে তিনটি মেডিকেল অক্সিজেন প্ল্যান্ট। যেখানে প্রতি ঘণ্টায় ১ লাখ ৯ হাজার লিটার অক্সিজেন উৎপাদন করা হয়। জানা যায়, অধ্যাপিকা ড. হোসনে আরা বেগম জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৩ সালে বগুড়া সদর উপজেলার ঠেঙ্গামারা গ্রামে। তার পিতা সোলাইমান আলী পাইকার। মাতার নাম জোবাইদা বেগম। জন্মের সময় স্বাভাবিক পুরুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় ২৩ বছর বয়সে অলৌকিকভাবে শারীরিক পরিবর্তন ঘটলে তিনি অপারেশনের মাধ্যমে যুবক আবদুস সামাদ থেকে নারী হোসনে আরা বেগম হয়ে এক নতুন জীবন শুরু করেন। পুরুষ ছাত্রাবাস থেকে তাঁকে চলে যেতে হয় ছাত্রীবাসে। সে সময় খুব দুর্বিষহ জীবন কেটেছে। ১৯৭৫ সালে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণি নিয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করেন। গড়েছেন সংসার। বগুড়া সরকারি মুজিবুর রহমান মহিলা কলেজে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন ড. হোসেন আরা বেগম। শিক্ষকতা চালিয়ে যাওয়ার সময় এক দিন তাঁর গ্রামের ফাতেমা বেওয়া (ফুতু বুড়ি) দেখা করেন। দেখা করে ফাতেমা বেওয়া ভিক্ষুকদের নিয়ে গড়া একটি সমিতির কথা জানান। ভিক্ষুকদের সেই সংগঠনের কাজ ছিল সারা দিন যা চাল ভিক্ষা করে পাবে তা থেকে একমুঠ করে চাল জমিয়ে রেখে বিপদে-আপদে সহযোগিতা করা। ১৯৮০ সালে ভিক্ষুকদের সংগঠনের দায়িত্ব নেওয়ার সময় জমা ছিল ২০৬ মণ চাল। আর ছিল ১৪ দলে বিভক্ত ১২৬ ভিক্ষুক। দায়িত্ব গ্রহণ করে চার গ্রামের ভিক্ষুকদের নিয়ে একটি সম্মেলন করেন। এ সম্মেলনে এলাকার ভিক্ষুকদের খিচুড়ি খাওয়ান। খিচুড়ি খাওয়ানোর পর তাদের সদস্য সংখ্যা ৩৭৬ জনে দাঁড়ায়। ভিক্ষুকদের চাল জমানো আর তাদের সংগঠনের নেত্রী হওয়া নিয়ে সমাজের নানা মানুষ নানা কথা বলতে থাকে। সেসব কথাকে উড়িয়ে দিয়ে ভিক্ষুকদের উন্নয়নে কাজ করে যান তিনি। একটা সময় চাল নেওয়া বন্ধ করে দিয়ে ২ টাকা করে সঞ্চয় সংগ্রহ শুরু করেন। ভিক্ষুকদের এ সঞ্চয় থেকেই গড়ে ওঠে ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ (টিএমএসএস)। এ সংগঠনের মাধ্যমে অনেক ভিক্ষুক সদস্যই নানা সহযোগিতা পেয়ে ভাগ্যবদল করেছেন। ধীরে ধীরে এ সংগঠনের সঙ্গে অনেকেই যুক্ত হতে থাকেন। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে বিভিন্নজনের সহযোগিতায় অবহেলিত মানুষের উন্নয়নে কাজ করে যায় টিএমএসএস। বাড়তে থাকে বিস্তৃতি। এরপর সবই রূপকথার মতো। যা এখন চোখে দেখা যায়। গড়েছেন অসংখ্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। মেডিকেল কলেজ, নার্সিং কলেজ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, ট্রাভেল্স অ্যান্ড ট্যুরিজম, পুণ্ড্র ইউনির্ভাসিটিসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গরিব রোগীদের জন্য চিকিৎসাসেবা হাসপাতাল, সিএনজি স্টেশন, পাঁচ তারকা হোটেল মমইন, রয়েছে নিজস্ব হেলিকপ্টারসহ বিভিন্ন সম্পদ। ড. হোসনে আরা বেগম ২০০৭ সালে রোকেয়া পদক পেয়েছেন। জনগোষ্ঠীর চাহিদার ভিত্তিতে টিএমএসএস বর্তমানে নানা ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলেছে। এর মধ্যে রয়েছে- স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিবার পরিকল্পনা, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা, মেডিকেল শিক্ষা, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ, ঋণ কর্মসূচি, মানবাধিকার ও জেন্ডার কর্মসূচি, কৃষি ও পরিবেশ উন্নয়নসহ অন্যান্য বিষয়। টিএমএসসের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপিকা ড. হোসনে আরা বেগম গত ৪৮ বছরে ৭০ থেকে ৮০ লাখ নারীকে স্বপ্ন দেখিয়ে আলোর মুখে ধাবিত করেছেন। দেশের সব জেলায় তিনি কোনো না কোনো নারীর উন্নয়নে জড়িয়েছেন। সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে ও পারিবারিক আয় বৃদ্ধি করতে নারীদের দিয়েছেন বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রশিক্ষণ, নিরাপত্তা, সচেতনতা, সামাজিক ব্যাধি থেকে নারীকে সুরক্ষায় প্রশিক্ষণ। এসব প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি তিনি কয়েক হাজার নারীকে চাকরিও দিয়েছেন। দীর্ঘ ৪৮ বছর ধরে শ্রম দিয়ে তিনি গড়ে তুলছেন দেশের নামি বেসরকারি মহিলা উন্নয়ন সংগঠন টিএমএসএস। দেশের দরিদ্র মহিলা জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে কাজ করতে গিয়ে দেশে-বিদেশে পরিচিতি লাভ করেছেন অধ্যাপিকা ড. হোসনে আরা বেগম (অশোকা ফেলো অ্যান্ড পিএইচএফ)। পরিবারই হোক নারী উন্নয়নের কেন্দ্রস্থল- এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি কাজ শুরু করেন। দেশের ৬৪ জেলায় এখন উপকারভোগীর সংখ্যা ১ কোটি ৭৬ লাখ। দেশে করোনাভাইরাস হানা দিলে অসংখ্য মানুষকে সেবা ও খাবার দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। তিনি ১ হাজার গরিব ও এতিম শিক্ষার্থীকে বিনা খরচে পড়াশোনার সুযোগ করে সুনাম কুড়িয়েছেন। মাতৃস্নেহের বন্ধনে স্থাপন করেছেন প্রবীণ নিবাস। টিএমএসএসের ডেপুটি নির্বাহী পরিচালক রোটারিয়ান ডা. মো. মতিউর রহমান জানান, টিএমএসএস একটি নন প্রফিট ট্রাস্টি অর্গানাইজেশন। এটির অধীনে টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ ও রফাতউল্লাহ কমিউনিটি হাসপাতাল উত্তরবঙ্গে চিকিৎসা সেবায় নতুনত্ব এনেছে। টিএমএসএসের প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপিকা ড. হোসনে আরা বেগম জানান, টিএমএসএস একটি অংশীদারি ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের আয় দিয়ে চলছে প্রবীণ নিবাস। গরিব ও অসহায় মানুষকে নানাভাবে সহায়তা প্রদান অব্যাহত রয়েছে। টিএমএসএসে বর্তমানে ৫০ হাজার কর্মী নিয়োজিত রয়েছেন। এ পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠান থেকে ২২ লাখ পরিবার সুফল পেয়েছে।