মিল্লি, ম্যান্দা বা পিঠালি নামের মুখরোচক খাবারটির নাম শুনলেই যে অঞ্চলের নাম প্রথমেই ভেসে ওঠে তা হচ্ছে জামালপুর। এ অঞ্চলের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সুস্বাদু খাবারের নামই হচ্ছে মিল্লি। জামালপুরের ঐতিহ্যবাহী খাবার মিল্লি তৈরির প্রক্রিয়া সহজ নয়। নির্দিষ্ট কয়েকজন বাবুর্চি এ খাবারটি সুস্বাদুভাবে তৈরি করতে পারেন। মুখরোচক মিল্লি তৈরির জন্য মাংস নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। মিল্লিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় গরু এবং মহিষের মাংস। চর্বি এবং হাড়যুক্ত মাংস মিল্লির জন্য সবচেয়ে ভালো। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান চালের গুঁড়া। মূলত চালের গুঁড়া মিল্লিকে ঘন করার পাশাপাশি এর ভিন্ন স্বাদ তৈরি করে। মিল্লিতে মাংস, চালের গুঁড়া ছাড়াও তেল, পিঁয়াজ, রসুন, আদা, জিরা, এলাচ, দারুচিনি, তেজপাতাসহ অন্তত ২০ রকমের মসলা ব্যবহার করা হয়। এসব মসলা কষানোর পর মিল্লিতে এক অনন্য স্বাদ তৈরি হয়। মিল্লিতে অতুলনীয় স্বাদ আনতে বাবুর্চিদের বাগাড় দেওয়ার প্রক্রিয়ায় তাদের রেসিপির আসল রহস্য লুকিয়ে থাকে। মূলত এ কারণেই সব বাবুর্চি মিল্লি তৈরিতে পারদর্শী হন না।
জামালপুর অঞ্চলের ঐহিত্যবাহী মিল্লি দেখতে অনেকটা হালিমের মতো মনে হলেও, আসলে এটি হালিম না। এর স্বাদ অতুলনীয় এবং ঘ্রাণে রয়েছে মোহনীয়তা। মিল্লির সঙ্গে স্থানীয় মুসলমানদের ধর্মীয় মূল্যবোধ নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। কেউ মারা গেলে তার কুলখানি, মৃত্যুবার্ষিকী, সুন্নতে খতনা, আকিকাসহ বিভিন্ন সামাজিক আচার অনুষ্ঠান উপলক্ষে মিল্লি পরিবেশন করা হয়। ছোট আয়োজনগুলোতে ৫ শতাধিক মানুষের মিল্লি ভোজের আয়োজন থাকলেও বৃহৎ আয়োজনগুলোতে ১০ থেকে ৫০ হাজার মানুষকে দাওয়াত দেওয়া হয়। কয়েক গ্রামের মানুষকে স্থানীয় মসজিদের মাইকে মাইকিং করে দাওয়াত দেওয়া হয়। যে বাড়িতে এই মিল্লি রান্নার আয়োজন হয় সেই বাড়িতে উৎসবের আমেজ লেগে থাকে। ছোট-বড় আয়োজনের প্রকার ভেদে ৫০ থেকে ৫০০ বড় হাঁড়িতে রান্না হয় মিল্লি। মানুষের ভিড় সামলে খাবার পরিবেশন করতে থাকে স্বেচ্ছাসেবী গ্রুপ। মূলত এই স্বেচ্ছাসেবী গ্রুপের সদস্যরা শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দাওয়াতে আসা মানুষকে খাবার পরিবেশন করে। বড় কিংবা ছোট মিল্লির আয়োজন হলেই এই অঞ্চলের উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্তের মানুষ একসঙ্গে মিল্লি ভোজে অংশ নেন। মিল্লি কিন্তু থালা কিংবা বাটিতে পরিবেশন করা হয় না। এর জন্যও রয়েছে আলাদা ঐতিহ্য। ভাতের সঙ্গে গরম গরম মিল্লি পরিবেশন করা হয় কলার পাতা কিংবা কলা গাছের খোলে, আর সেটাও খেতে হয় মাটিতে বসে। ছোট আয়োজনগুলোতে বাড়ির উঠানে খাবার পরিবেশন করা গেলেও বড় আয়োজনের সময় বাড়ির উঠান ছাড়িয়ে গ্রামের রাস্তা এবং ফসলি জমিতে বসে খেতে হয় সবাইকে। এ সময় ধনী, গরিব সবাই মিল্লির ঐতিহ্যকে ধারণ করে কলাপাতা কিংবা কলা গাছের খোলে খাবার নিয়ে মাটিতে বসে খাবার খান।
ধারণা করা হয়, জামালপুরবাসী শত বছরের বেশি সময় ধরে মিল্লির ঐতিহ্য লালন করে আসছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, বিচার-সালিশ বৈঠক ছাড়াও বিয়ের অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হতো মিল্লি। আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বর্তমান সময়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে মিল্লি পরিবেশন না করা হলেও বিভিন্ন সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে এখন এটি পরিবেশন করা হয়। আজকাল মিল্লির জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় সামাজিক আচার অনুষ্ঠান ছাড়াও জামালপুরের বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁর মেন্যুতে যুক্ত হয়েছে। জামালপুর ছাড়াও দূরদূরান্ত থেকে আসা মানুষ এসব হোটেল-রেস্তোরাঁয় এসে মিল্লি স্বাদ নিতে পারছে, তবে মজলিসের মিল্লির স্বাদ এসব হোটেল-রেস্তোরাঁয় পাওয়া যাবে না। মিল্লির ঐতিহ্যকে ধারণ করে ইতোমধ্যে জামালপুরে ‘মিল্লি সংঘ’ নামে একটি সংগঠন রয়েছে। যারা মিল্লির ঐতিহ্য সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে এবং প্রতি বছর মিল্লি উৎসব পালন করে। শত বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসা মিল্লির ঐতিহ্য জামালপুরবাসীর মাঝে যুগ যুগ ধরে টিকে থাকবে এটাই প্রত্যাশা।