নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এখন নিজেই ‘রোগী’। ওষুধ সরবরাহে অনিয়ম, পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি কয়েকযুগ ধরে তালাবন্ধ, সেবার ঘাটতি, অপারেশন থিয়েটার শুরু থেকেই তালাবন্ধ, রোগীদের নিম্নমানের খাবার পরিবেশন, একজনের পরিবর্তে অপরজনের ভাড়া ডিউটিসহ হাতপাতালের নোংরা পরিবেশ এখন নিত্যদিনের সঙ্গী।
এছাড়াও হাসপাতালের নিজস্ব কোয়াটারে থাকেন না রেজিষ্টার্ড চিকিৎসকরা। এতে করে সেবার মান ভেঙ্গে পড়েছে হাসপাতালটিতে।
জানা যায়, এ হাসপাতালের রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসক সংখ্যা ১৩ জন। তাদের মধ্যে মাত্র ৫ জন চিকিৎসক হাসপাতালের কোয়ার্টারে থাকেন। আর বাকি সব ডাক্তার বগুড়াসহ বিভিন্ন জেলা থেকে এ হাসপাতালে যাতায়াত করেন। তাই রেজিস্টার্ড চিকিৎসকদের নিকট থেকে ভালো চিকিৎসা সেবা পান না বলে জানিয়েছেন একাধিক এলাকাবাসী। হাসপাতালটির জরুরি বিভাগে চিকিৎসা সেবা নিতে হয়রানির শিকার হচ্ছেন রোগীরা। একাধিক ব্যক্তির অভিযোগ জরুরি বিভাগ থেকে গুরুতর অবস্থা না হলেও বগুড়ায় চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় রোগীদের।
বহির্বিভাগে রোগীরা সকাল ১০ টা থেকে ১২ টা পর্যন্ত চিকিৎসাসেবা পান। ১২ টার পর থেকেই হাসপাতালে শুনসান নিরবতা বিরাজ করে। এ হাসপাতালে প্রতিদিন মাত্র দুটি গ্রুপের এন্টিবায়োটিক সরবরাহ করা হয়। সেগুলো হলো সিপ্রোফ্লক্সাসিন এবং এমোক্সিসিলিন। হাসপাতালের এক্সে মেশিনসহ বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ মেশিন কয়েকযুগ ধরেই নষ্ট। বিভিন্ন ধরনের টেস্ট রোগীদের প্রায় একযুগ আগে থেকেই বাহিরের ডায়াগনস্টিক থেকে করতে হয়। বিভিন্ন ধরনের প্যাথোলজিক্যাল পরীক্ষাগুলোও বাইরে থেকে করতে হয়। অথচ অপারেশন থিয়েটারসহ কয়েক কোটি টাকার যন্ত্রপাতি তালাবদ্ধ রয়েছে। ফলে বিভিন্ন ধরনের বেসরকারি ডায়াগনষ্টিকের ব্যবসা এখন রমরমা।
৫০ শয্যা বিশিষ্ট এ হাসপাতালে প্রতিদিন নিম্নমানের খাবার পরিবেশন করা হয়। প্রতিদিন সকালে ১টি ৫ টাকা মূল্যের পাউরুটি ২টি সাগর কলা ১টি ডিম এবং দুপুর ও রাতে অত্যাধিক পানির ঝোল মিশ্রিত স্বাদবিহীন ঘাটি খেতে দেয়া হয় রোগীদের। এ হাসপাতালের কয়েকজন ক্লিনার এবং নিম্ন পদস্থ কর্মচারীরা নিজেরা হাসপাতালে ডিউটি করেন না। তারা ভাড়া করা লোক দিয়ে হাসপাতালে ডিউটি করান। হাসপাতালের হাজিরা খাতায় যাদের নাম রয়েছে তারা আসলে প্রকৃতপক্ষে হাসপাতালেই আসেন না বলে অভিযোগ।
রোগীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় বেশিরভাগ রোগীর ব্যবস্থাপত্রে এজিথ্রোমাইসিন নামক এন্টিবায়োটিক লিখে দেয়া হয়। কিন্তু তা হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করা হয় না। যা প্রতি ট্যাবলেটের মূল্য ৩৫ টাকা থেকে শুরু করে ৫০ টাকা পর্যন্ত।
এছাড়া হাসপাতালের নোংরা পরিবেশে একেবারেই লক্ষ্যণীয়। এ হাসপাতালের রোগীদের থাকার কক্ষের বেশকিছু ফ্যান এবং লাইট নষ্ট। দুস্থ এবং যাদের অন্যত্র চিকিৎসা নেয়ার সামর্থ্য নেই, তারাই শুধুমাত্র বাধ্য হয়েই এ হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। তবে হাসপাতালে ভর্তি হয়েও ক্যানোলা, বেশকিছু স্যালাইন এবং প্রয়োজনীয় বেশিরভাগ দামী ওষুধ বাইরের ডিসপেনসারি থেকে কিনতে হচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের রুমে ঢুকতেই চোখে পরে বেডের নোংরা পরিবেশ। সেখানকার পরিবেশ এবং দুর্গন্ধে সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়বেন। তাই বেশিরভাগ নিকটস্থ রোগীরা সারাদিন চিকিৎসা গ্রহণ করে রাতে নিজেদের বাসায় গিয়ে রাত্রিযাপন করেন। এই হাসপাতালে রোগীরা তাদের কাঙ্খিত ওষুধ দীর্ঘ মাস যাবৎ পাচ্ছেন না। হাসপাতালটিতে ডায়াবেটিস, প্রেসার এবং হার্টের ওষুধ গরীব অসহায় রোগীরা বাইরের ডিসপেনসারি থেকে ক্রয় করছেন। যেসব ওষুধ হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে তা ডাক্তারের প্রেসক্রিপসনের সাথে কাঙ্খিত ওষুধ মিলছে না।
উপজেলার কুতুবপুর এলাকার বাসিন্দা নাজমা আকতার জানান, সম্প্রতি সারিয়াকান্দি হাসপাতাল ভর্তি হয়েছিলাম। হাসপাতালের নোংরা পরিবেশে থাকতে পারিনি। সকালে বাইরের থেকে ইনজেকশন ক্রয় করে দেয়া হয়েছে। তাই ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যাই। যাওয়ার সময় ডাক্তার যেসব ওষুধ লিখে দিয়েছিলেন তার সবই বাইরে থেকে কিনতে বলেছিলেন।
সারিয়াকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. মাহবুব হোসেন সরদার জানান, বিষয়গুলো ক্ষতিয়ে দেখা হবে। যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে এগুলি সঠিক নয়। আমরা চেষ্টা করছি সেবার মান বাড়িয়ে দেয়ার। যাতে সারিয়াকান্দি উপজেলার কোনো রোগী চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত না হয়। হাসপাতালটিতে কোনো নোংরা পরিবেশ নেই।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল