তারা তিন বোন। তিন কন্যা নামেই ঢাকাই ছবির দর্শকদের কাছে পরিচিতি তাদের। তাই তিন কন্যা নাম নিলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে তিন বোন- সুচন্দা, ববিতা ও চম্পার মুখ। সেই সত্তর-আশি দশকের রুপালি জগৎ তাদের আলোয় ছিল আলোকিত। প্রথমেই সুচন্দার যাত্রা। ওই সময়টা কেবল সুচন্দা আর ববিতা রাজত্ব করে গেছেন নায়িকা হিসেবে। শোবিজে সুচন্দার পারিবারিক নাম কোহিনুর আক্তার চাটনী। চলচ্চিত্রে আগমন ঘটে ১৯৬৫ সালে। অভিনয় শুরু করেন প্রখ্যাত অভিনেতা কাজী খালেকের একটি প্রামাণ্যচিত্রে। সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘কাগজের নৌকা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ১৯৬৬ সালে তাঁর চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সালে জহির রায়হানের চলচ্চিত্র ‘বেহুলা’য় অভিনয় করেন। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছবি ‘জীবন থেকে নেয়া’। জহির রায়হানের জীবদ্দশায় ‘টাকা আনা পাই’ ও ‘প্রতিশোধ’ চলচ্চিত্র দুটি প্রযোজনা করেন। সুচন্দা প্রযোজিত ‘তিন কন্যা’ ছবিটি জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে। ‘তিন কন্যা’ মুক্তি পায় ১৯৮৬ সালে। এছাড়াও বেহুলা লখিন্দর, বাসনা ও প্রেম-প্রীতি চলচ্চিত্রগুলো প্রযোজনা করেন। তাঁর পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘সবুজ কোট, কালো চশমা’। ২০০৫ সালে স্বামী জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসের আলোকে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন এবং সেরা প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। বর্তমানে সুচন্দা চলচ্চিত্র থেকে দূরে আছেন। তিনি বলেন, আগের মতো মানসম্মত চলচ্চিত্র এখন আর নির্মাণ হচ্ছে না। তাই অভিনয় থেকে দূরে আছি। এখন নাতি নাতনিদের নিয়ে সময় কাটে। নিজের জীবনী নিয়ে একটি বইও লিখেছি। গত বছর একুশে বইমেলায় বইটি প্রকাশ হয়। ইচ্ছা আছে জহির রায়হান রচিত ‘বরফ গলা নদী’ উপন্যাসটি নিয়ে একটি ছবি নির্মাণের। বড় বোন সুচন্দার হাত ধরে চলচ্চিত্রে আসেন ববিতা। ঢাকাই ছবির দর্শকদের কাছে ‘অনঙ্গ বউ’ নামেই ববিতা পরিচিত। কারণ ১৯৭৩ সালে তিনি কলকাতার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ ছবিতে অনঙ্গ বউ চরিত্রে অভিনয় করে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হন। তাঁর পারিবারিক নাম ফরিদা আক্তার পপি। ববিতার মতে, ‘চলচ্চিত্রে অভিনয় করবেন এমন ভাবনা তাঁর মনেই ছিল না। বাড়িতে পড়াশোনার পাশাপাশি নাচ, গান, আবৃত্তি শিখতে হতো ঠিকই; কিন্তু সেগুলো চলচ্চিত্রের দিকে তাঁকে নিয়ে যাবে এ কথা ববিতা ভাবেননি কখনো। বড় বোন সুচন্দা অভিনীত জহির রায়হানের ‘সংসার’ চলচ্চিত্রে শিশুশিল্পী হিসেবে ববিতার আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৬৮ সালে। মাত্র ১৫ বছর বয়েসে। ছবিটিতে রাজ্জাক আর সুচন্দার মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ১৯৬৯ সালে জহির রায়হানের ‘শেষ পর্যন্ত’ ছবিতে নায়িকা হিসেবে প্রথম অভিনয় করেন ববিতা। পথচলা হিসেবে এভাবেই শুরু। বড় বোন সুচন্দার স্বামী ছিলেন জহির রায়হান। চলচ্চিত্রবিষয়ক খুঁটিনাটি অনেক কিছু তাঁর কাছ থেকেই শিখেছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পরপরই ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে মিরপুরে শহীদ হন জহির রায়হান। ববিতা এ নিয়ে আফসোস করে বলেন, জহির ভাই ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ ছবিটা বানাতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু দুঃখের বিষয় জহির ভাই ছবিটা শেষ করে যেতে পারলেন না। ১৯৭৬ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তনের পর টানা তিনবার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জেতেন ববিতা। তাছাড়া একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ‘শ্রেষ্ঠ প্রযোজক’ এবং ‘শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রী’ ক্যাটাগরিতে। তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে সবচেয়ে বেশিবার আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করেছেন। তাই তখন তাঁকে ‘ডটার অব ফেস্টিভ্যাল’ নামে আখ্যায়িত করা হতো। ২০১৮ সালে চলচ্চিত্রে অসাধারণ অবদানের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের মাধ্যমে ‘আজীবন সম্মাননা’য় ভূষিত হন দর্শকপ্রিয় এ অভিনেত্রী। ববিতা ২০১৫ সালে সর্বশেষ অভিনয় করেন নার্গিস আক্তারের ‘পুত্র এখন পয়সাওয়ালা’ ছবিতে। তাঁর কথায় এখন আমাদের গুরুত্ব চরিত্র লেখা হয় না। তাই গুরুত্বহীন কোনো চরিত্রে কাজ করে সারা জীবনের অর্জন নষ্ট করতে চাই না। যদি মনের মতো চরিত্র পাই তাহলে অবশ্যই অভিনয়ে ফিরব। আর নির্মাণে ফিরব কিনা সেটা নিয়ে এখন ভাবছি। এ অবসর তাঁর কীভাবে কাটে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঘরের কাজ, ধর্ম-কর্ম আর সমাজকল্যাণমূলক কাজ করে এখন সময়টা ভালোই কেটে যাচ্ছে। তা ছাড়া সময় সুযোগ পেলেই কানাডাপ্রবাসী পুত্র ও যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ভাইদের কাছে চলে যান এবং সুন্দর সময় কাটান। ববিতাকে ২০১২ জাতিসংঘের যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সুবিধাবঞ্চিত নারী ও শিশুদের দেখভালে ডিসিআইআইয়ের শুভেচ্ছাদূত নিয়োগ করা হয়।
তিন বোনের মধ্যে ছোট বোন চম্পার পারিবারিক নাম গুলশান আরা আক্তার। আশির দশকে বড় বোন সুচন্দা প্রযোজিত ও শিবলী সাদিক পরিচালিত ‘তিন কন্যা’ ছবির মাধ্যমে চম্পার চলচ্চিত্রজগতে আগমন। সে ছবিতে বাকি দুই কন্যা হিসেবে চম্পার দুই বোন সুচন্দা আর ববিতা অভিনয় করেন। চম্পার অভিনয় দক্ষতা ও ছবির ব্যবসায়িক সাফল্য তাঁকেও চলচ্চিত্রে সাফল্য এনে দেয়। সামাজিক ও অ্যাকশন-উভয়ধর্মী চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। কোনো নির্দিষ্ট গন্ডিতে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখেননি। তিনি সত্যজিৎ রায়ের ছেলে সন্দীপ রায়ের ‘টার্গেট’ ছবিতে এবং বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘লাল দরজা’ ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ পান। এছাড়া কলকাতার গৌতম ঘোষের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ছবিতে অভিনয় করে পুরস্কৃত হন। গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় মাপের কাজ। চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে শতাধিক সিনেমাতে অভিনয় করেছেন তিনি। সুচন্দা-ববিতা কাজে অনুপস্থিত থাকলেও চম্পা এখনো অভিনয় করে চলেছেন। টিভি নাটকেও তিনি অভিনয় করেন। বেশ কিছুদিন ধরে অভিনয়ে নিয়মিত নন তিনি। তাঁর কথায়- এর কারণ একটাই মানসম্মত গল্প ও চরিত্র পাচ্ছেন না তিনি। চম্পার একমাত্র সন্তান এশা দেশের বাইরে থাকায় প্রায়ই তিনি মেয়েকে সময় দিতে দেশের বাইরে থাকেন। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে থাকা প্রবাসী ভাইদের কাছেও সময় সুযোগ করে চলে যান তিনি। তাঁর কথায়- এভাবেই আমার সুন্দর সময় কেটে যাচ্ছে। বর্তমানে তিনি মেজ বোন ববিতার সঙ্গে কানাডায় আছেন।