শিল্পীর সঙ্গে নির্মাতার প্রতারণার ঘটনা নতুন কিছু নয়। চলচ্চিত্র, নাটক, গানসহ মিডিয়ার সর্বক্ষেত্রে হরহামেশা এই প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। একসময়ের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র অভিনেত্রী শাবানাও নির্মাতাদের বিরুদ্ধে কাজ করিয়ে পারিশ্রমিক না দেওয়ার অভিযোগ করেছিলেন।
রাণী সরকার এখন মৃত্যুশয্যায়। চরম অর্থকষ্টে খাওয়া-দাওয়া তো দূরে থাক চিকিৎসার পয়সাও জুটছে না তার। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, 'জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকতেই কত নির্মাতা আমাকে টাকা না দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়েছেন এবং তাদের ছবি ভালো ব্যবসাও করেছে। অথচ তখন তো আমার পাওনা দেয়নি। এখন আমি অর্থকষ্টে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর প্রহর গুনছি। এখন তারা আমার বকেয়া টাকা দেওয়া দূরে থাক আমার খবরও নেয় না।'
চলচ্চিত্র শিল্পীদের সঙ্গে প্রতারণার এমন অজস্র ঘটনা রয়েছে, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপ্রকাশিতই থেকে যায়। সম্প্রতি আবারও এমন প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। তাও আবার সিনিয়র শিল্পী আনোয়ারা, মিশা সওদাগর এবং বর্তমান সময়ের জায়েদ খানের সঙ্গে। এতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে শিল্পী সমিতি।
তারা বিভিন্ন চলচ্চিত্র সংগঠন, সেন্সর বোর্ড, তথ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছে এই বলে যে, যদি এই অবস্থা চলতে থাকে তাহলে শিল্পীরা ধর্মঘটের ডাক দেবে। কাজ বন্ধ করে দেবে।
নতুন করে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে যখন সিমি আক্তার কলি নামের এক প্রযোজক উল্লিখিত শিল্পীদের পারিশ্রমিক না দিয়ে ছবির নাম, পরিচালক পাল্টিয়ে সেন্সর বোর্ডে ছবিটি জমা দেয়। গত বছরের অক্টোবরে জাদু আজাদকে পরিচালক করে 'অপরাধী বাদশা' শিরোনামে একটি ছবির কাজ শুরু করে প্রযোজক সিমি। এই শিরোনামেই এফডিসিতে ছবিটি এন্ট্রি হয়। শুধু তাই নয়, ব্যাংককের পাতায়ায় এর শুটিংয়ে যাওয়ার সময় মন্ত্রণালয়েও 'অপরাধী বাদশা' নাম জমা দেওয়া হয়। কথা ছিল ডাবিংয়ের আগে শিল্পীদের পারিশ্রমিক পরিশোধ করা হবে।
এই অভিযোগ করে উল্লিখিত শিল্পীরা বলেন, 'শুধু শিল্পী নয়, নির্মাতার সঙ্গেও প্রতারণা করে সিমি। জাদুকে বাদ দিয়ে মনতাজুর রহমান আকবরের মাধ্যমে ছবির কাজ শেষ করিয়ে তা সেন্সর বোর্ডে জমা দেয়। শিল্পীদের অর্থ পরিশোধ না করার জন্য গোপনে অন্যদের দিয়ে ডাবিং করানো হয়।'
এই ঘটনার কথা পরিচালক সমিতিকে জানানো হলে সমিতির মহাসচিব গুলজার শিল্পীদের জানান, তারা যেন পরিচালক সমিতির সঙ্গে কথা না বলে কারও ছবিতে কাজ না করে। অথচ মনতাজুর রহমান আকবর গোপনে সিমির ছবির কাজ করায় ক্ষোভ জানিয়েছেন শিল্পীরা।
এদিকে সংশ্লিষ্ট শিল্পীরা এই প্রতারণার বিষয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়, এফডিসি কর্তৃপক্ষ, প্রযোজক, পরিচালক সমিতি এবং সেন্সর বোর্ডের কাছে চিঠি দিয়েছে যাতে সমস্যার সমাধান ছাড়া ছবিটিকে ছাড় দেওয়া না হয়। বর্তমানে 'মাই নেম ইজ সিমি' নামে ছবিটি সেন্সর বোর্ডে জমা দেওয়া হয়েছে বলে শিল্পী সমিতি জানায়।
জায়েদ খান বলেন, অর্থ এবং ছবির চরিত্রের ক্ষেত্রেও আমার সঙ্গে বড় ধরনের প্রতারণা করা হয়েছে। কারণ ছবির শিরোনাম ছিল 'অপরাধী বাদশা' মানে নায়ককেন্দ্রিক গল্প। সেই হিসেবে এতে কাজ করি। বিদেশে যাওয়ার সময়েও মন্ত্রণালয়ে এই নামই এন্ট্রি করা হয়। কিন্তু এখন নাম পাল্টে রাখা হয়েছে 'মাই নেম ইজ সিমি'। মানে নায়িকাপ্রধান ছবি। এমন প্রতারণা কখনো মেনে নেব না।
প্রয়োজনে আইনের আশ্রয় নেব।
এ ব্যাপারে সিমির সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তিনি কারও সঙ্গে কথা বলতে নারাজ বলে জানিয়ে দিয়েছেন। মনতাজুর রহমান আকবর বলেন, 'পরিচালক সমিতির অনুমতি নিয়েই ছবির নাম ও নির্মাতা পরিবর্তন করেছেন প্রযোজক সিমি। বিষয়টি অস্বীকার করেছে পরিচালক সমিতি।'
শিল্পীরা বলেন, 'ঢালিউডের যাত্রালগ্ন থেকে প্রথমে সাইনিং মানি এবং ডাবিংয়ের আগে সমুদয় পারিশ্রমিক পরিশোধের নিয়ম চালু রয়েছে। এই সুযোগে অসাধু নির্মাতারা শিল্পীদের ঠকিয়ে আসছে। এ নিয়ম বাতিল করা জরুরি হয়ে পড়েছে। না হলে এই প্রতারণা ঠেকানো যাবে না।'
চলচ্চিত্র বোদ্ধারা বলছেন, নব্বই দশকের শেষ দিক থেকে এমনিতেই চলচ্চিত্রের অবস্থা ভালো নয়, তার ওপর যদি চলচ্চিত্রের মানুষ প্রতারণার মতো অনৈতিকতার পথে হাঁটতে থাকে তাহলে এ দেশে চলচ্চিত্র শিল্পের মতো সবচেয়ে বড় গণমাধ্যমটি অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। যার লক্ষণ ইতোমধ্যে দেখা দিতে শুরু করেছে। এ দেশে ভারতীয় ছবির বাজার তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।