রাজ্জাক
মানসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণের পূর্বশর্ত হচ্ছে উন্নত গল্প ও চিত্রনাট্য। যার অভাব এখন প্রকট। সিনিয়র গল্পকার ও চিত্রনাট্যকারদের বেশির ভাগই বেঁচে নেই। আমাদের দেশে সীমিত বাজেট দিয়ে বলিউড বা তামিল ছবির গল্প নকল করাও যে সম্ভব নয় তাও অনেকে বোঝেন না। ফলে দেশীয় সংস্কৃতি সমৃদ্ধ চলচ্চিত্র নির্মাণের নিয়মের বাইরে গিয়ে এ শিল্পের বারোটা বাজাচ্ছেন অনেকে। মনে রাখতে হবে, শুধু আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে দর্শকদের আকৃষ্ট করা যাবে না, প্রয়োজন সত্যিকারের বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণ। আমার বিশ্বাস মৌলিক গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ হলে আবার দর্শক প্রেক্ষাগৃহে ফিরবে। তা ছাড়া প্রেক্ষাগৃহের পরিবেশ ফিরিয়ে আনা ও এফডিসিকে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর করার বিকল্প নেই।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার
এখনকার নির্মাতাদের মধ্যে নকল প্রবণতা জেঁকে বসেছে। আগে ধ্যানধারণা ছিল শিল্পমুখী। আর এখনকার দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি বাণিজ্যিক। ফলে দর্শক বড় পর্দার গল্পে জীবনের প্রতিচ্ছবি আর স্বপ্নের বাস্তবায়ন না পেয়ে হতাশ হচ্ছেন। প্রযুক্তির উন্নয়ন হয়েছে কিন্তু এক বা দুই মাসের মধ্যে যেনতেন গল্পে কোনোভাবে ডিজিটাল চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে এর মান নষ্ট হচ্ছে। তা ছাড়া একসময় গান ছিল ছবির প্রাণ। সিকোয়েন্সের প্রয়োজনে গান হতো। আর এখন গানের জন্য সিকোয়েন্স হয়। মানসম্মত গীতিকারেরও এখন অভাব। তা ছাড়া সবকিছু আধুনিক হয়ে পড়েছে। আধুনিকতা মন্দ নয়। তবে লক্ষ রাখতে হবে এতে যেন মন্দ প্রভাব না পড়ে। সব মিলিয়ে সত্যিকারের চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে।
আমজাদ হোসেন
বর্তমানে ডিজিটালের নামে স্বল্প খরচ ও কারিগরি সীমাবদ্ধতায় ছবি নির্মাণ করতে গিয়ে নাটকই নির্মাণ হচ্ছে বেশি। ৩৫ মিলিমিটারে নির্মাণে বাধা কোথায়। ৩৫ এ সমস্যা হলে ১৬ মিলিমিটারে নির্মাণ করা যেতে পারে। এই পদ্ধতি আরও ভালো। কারণ ১৬ মিমিতে শুট করে তা ব্লোআপ করলে আরও স্বচ্ছ ও পরিষ্কার ছবি দেখা যায়। ৫০ এর দশকে ভারতে এ প্রযুক্তিতে মেহবুব দিলীপ কুমারকে নিয়ে 'আন' ছবিটি নির্মাণ করেন। আমাদেরও এই পদ্ধতিতে নির্মাণ করা দরকার। যদিও ১৬ মিলিমিটারের ক্যামেরা এফডিসিতে নেই। তবে একটি ক্যামেরা ডিএফপিতে আছে। সরকার যদি সেটি দেয় এবং আরও কয়েকটি ক্যামেরা আনে তাহলে সমস্যা থাকার কথা নয়। তা ছাড়া গল্প ও প্রেক্ষাগৃহের পরিবেশের দিকেও নজর দিতে হবে।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী
নিজ দেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির প্রতি লক্ষ রেখে জীবনের গল্প বলতে হবে। মানে নকল নয়, আমাদের ঢংয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে। আমাদের চার পাশে গল্প বলার আয়োজনের বা ফরমেটের অভাব নেই। তাহলে আমাদের তামিল বা তেলেগু ঢংয়ে গল্প বলতে হবে কেন? আমরা কেন আমাদের ঢংয়ে গল্প বলব না, এ প্রশ্নটি আমাদের নিজেদেরই নিজেদেরকে এখন করতে হবে। কয় বছর আগেও আমাদের চলচ্চিত্রে যে দুরবস্থা ছিল এখন তা কেটে উঠছে। নতুন প্রযোজনা সংস্থা, নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পী, নতুন আঙ্গিকের গল্প আসছে এবং ভালো করার চেষ্টা হচ্ছে। এতে ভালো ফলও পাওয়া যাচ্ছে। আমার বিশ্বাস এভাবে এগুলে চলচ্চিত্রের সুদিন পুরোপুরি ফিরবে। তবে হয়তো একটু সময় লাগবে।
সুচন্দা
এখনতো ডিজিটাল চলচ্চিত্রের নামে মানহীন চলচ্চিত্র নির্মাণ হচ্ছে। এতে গল্প বলে কিছু নেই। ফলে দর্শক বারে বারে বিরক্ত ও দেশীয় চলচ্চিত্র বিমুখ হচ্ছে। শুধু প্রযুক্তিগত গ্লামার দিয়ে তো দর্শকমন জয় করা যাবে না। গল্প ও অভিনয়ে জোর থাকতে হবে। যা এখন নেই। এখনকার নির্মাতারা প্রযুক্তির মেধা নিয়ে কথা বলেন কিন্তু গল্প আর চিত্রনাট্যের অভাব নিয়ে চিন্তা করেন না। মৌলিকত্ব নষ্ট হওয়ায় চলচ্চিত্র আর আবেদন রাখতে পারছে না। দর্শক গ্রহণযোগ্য চলচ্চিত্রের পূর্বশর্ত হচ্ছে মানসম্মত গল্প।
সৈয়দ শামসুল হক, রাবেয়া খাতুন, সেলিনা হোসেনসহ অনেক প্রখ্যাত মৌলিক গল্পকার আছেন, যাদের গল্প নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে ছবি নির্মাণ করা যায় ও চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
অনুপম হায়াৎ
সত্যিকারের গল্প, চিত্রনাট্য, নির্মাণ, অভিনয়, উপস্থাপনা ও কারিগরি মানের অভাবে চলচ্চিত্রে এখন দৈন্যদশা চলছে। শুধু ডিজিটাল প্রযুক্তি হলে চলবে না। এর সঙ্গে মেধা জরুরি। তা এখন কোথায়? এখন সুভাষ দত্ত, খান আতা, সালাউদ্দীন, কাজী জহির, জহির রায়হান, মিতা, আমজাদ হোসেনের মতো নির্মাতা কোথায়? পাশাপাশি রাবেয়া খাতুন, সেলিনা হোসেন, সৈয়দ শামসুল হকের মতো গল্পকারদের গল্প নিয়ে এখন আর চলচ্চিত্র নির্মাণ হয় না। তা ছাড়া উম্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতিসহ অনেক সমস্যা রয়েই গেছে।
মোবাইল ও নেটে সহজে ছবি দেখা এবং ফুটপাতে ২০/৩০ টাকায় ছবি কেনা যায়। এসব প্রতিকূলতা কাটাতে পারলে চলচ্চিত্র আবার প্রাণ ফিরে পাবে।