২৫ অক্টোবর, ২০২১ ১৩:২৬

সিনেমায় প্রপস আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার ও দুর্ঘটনা

আলী আফতাব

সিনেমায় প্রপস আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার ও দুর্ঘটনা

১৯৮৪ সালে টেলিভিশন সেটে অভিনয়ের সময় প্রপস অস্ত্রের গুলিতে প্রাণ হারান জন এরিক হেক্সাম (বামে)। ১৯৯৩ সালে দ্য ক্রো সিনেমার শুটিংয়ে ব্যবহৃত পয়েন্ট ফোর ফোর ক্যালিবার বন্দুকের গুলিতে মারা যান ব্রেন্ডন লি (ডানে)

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকোর একটি শুটিং স্পটে চলছিল হলিউড ছবি ‘রাস্ট’-এর শুটিং। গোলাগুলির একটি দৃশ্যে ছিলেন ‘মিশন ইম্পসিবল’ ছবির অভিনেতা অ্যালেক বল্ডউইন। চিত্রনাট্য অনুসারেই সবকিছু চলছিল। হঠাৎ ঘটল এক বিপত্তি। অ্যালেক বল্ডউইনের হাতে থাকা প্রপসের বন্দুক থেকে বেরিয়ে এলো সত্যিকারের বুলেট। সঙ্গে সঙ্গে মারা যান ছবির মুখ্য চিত্রগ্রাহক হ্যালিনা হাচিনস। গুরুতর আহত হন ছবির পরিচালক জোল সুজা। এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ। আপাতত তদন্ত চলছে। শুটিংয়ের বন্দুক থেকে কী করে গুলি বেরিয়ে এলো, আর সেসব শুটিং সেটে কী করে ঢুকল- এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে পুলিশ। পাশাপাশি এসব অস্ত্র দেখাশোনার দায়িত্ব কাদের দেওয়া হয়েছিল, সে বিষয়েও খোঁজ নিচ্ছে তারা।

 
কেন প্রপস গান বিপজ্জনক
ঠিকমতো ব্যবহার না জানলে প্রপস গানও (সিনেমায় ব্যবহৃত নকল পিস্তল বা রাইফেল) কেড়ে নিতে পারে জীবন। শুক্রবার অ্যালেক বল্ডউইনের গুলিতে মার্কিন সিনেমাটোগ্রাফার হ্যালিনা হাচিনসের মৃত্যুর পর এমনটাই বলছেন সিনেমার প্রপস বিশেষজ্ঞরা।

কানাডার মুভি আর্মামেন্টস গ্রুপের অস্ত্র বিষয়ক প্রধান চার্লস টেলর বললেন, ‘প্রপস আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের সময় ক্রুদের কঠিন নিয়ম মেনে চলতে হয়। আমাদের কানাডার আইনে তো সিনেমার সেটে অস্ত্র ব্যবহারের জন্যও লাইসেন্স নেওয়ার বিধান আছে। এমনকি যারা ওই গান ব্যবহার করতে চায় তাদের প্রশিক্ষণও নিতে হবে।’ টেলর আরও জানালেন, ‘সিনেমায় প্রপস গান ব্যবহারের আগেও অভিনয়শিল্পীদের এ নিয়ে সপ্তাহখানেকের প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এরপর সিনেমার অস্ত্রবিষয়ক প্রধান (ওয়েপন মাস্টার) ঠিক করবেন, কী করে অস্ত্র ও গোলাগুলি সংক্রান্ত দৃশ্যের চিত্রায়ণ করা হবে।’ হলিউডের আগ্নেয়াস্ত্রবিষয়ক সমন্বয়ক ক্যামেরন কে স্মিথ বললেন, ‘প্রপস গান হাতে থাকা ব্যক্তি যদি অমনোযোগী, নির্বিকার কিংবা দ্বিধায় ভোগেন, তবে ওই বন্দুক দারুণ বিপদ ডেকে আনতে পারে।’

 
আসল ও প্রপস গানের পার্থক্য

টেলর জানালেন, এখনকার সিনেমায় ব্যবহৃত বেশির ভাগ প্রপস আগ্নেয়াস্ত্র মূলত সত্যিকারের অস্ত্রের পরিবর্তিত রূপ। আসল অস্ত্রে যেন সত্যিকারের বুলেট বের হতে না পারে সেভাবেই প্রপস গান তৈরি করা হয়। এখনকার সিনেমা বা সিরিয়ালগুলোতে খেলনা বন্দুক বা নকল পিস্তল ব্যবহার করা হয় না, কারণ তা দেখে আসলটার মতো মনে হবে না। টরেন্টোর সিনেমাবিষয়ক শিক্ষক আকওয়াসি বেমপাহ জানালেন, ‘প্রপস গান তৈরিতে আসল বন্দুক ব্যবহারের উদ্দেশ্য হলো এতে বন্দুকের রিকয়েল (বিপরীতমুখী ধাক্কা), বন্দুক থেকে নির্গত ধোঁয়া, আলোর ঝলকানি- এসব দেখা যায়। প্রপস গানে আসল বুলেট ব্যবহার করা হলে তা সত্যিকারের পিস্তলই হয়ে যাবে।’ তবে ওয়েস্টার্ন মুভি ‘রাস্ট’-এর শুটিংয়ে অ্যালেক বল্ডউইনের হাতে ঠিক কী ধরনের প্রপস গান ছিল তা এখনো জানা যায়নি।


‘প্রপস গান’ নিরাপদে কীভাবে ব্যবহার করা যায়

হেক্সামের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ‘ব্ল্যাংক কার্ট্রিজ’ নিয়ে সমস্যাটি সামনে আসে। কার্তুজের অগ্রভাগে কোনো ‘বুলেট’ কিংবা নিক্ষিপ্ত হওয়ার মতো কিছু না থাকলেও বিস্ফোরণে প্রচ- শক্তি নির্গত হয়। দৃশ্যকে প্রাণবন্ত করে তোলার জন্য কিছু সিনেমার সেটে অতিরিক্ত বিস্ফোরকের গুঁড়া ব্যবহার করায় ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। সিনেমার সেটে সাধারণত ‘প্রপস গান’ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ম মানতে হয়। বিশেষজ্ঞরা সেটে ব্যবহারের উপযোগী আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহ করে থাকেন এবং সেসব ব্যবহারের নিয়মও বাৎলে দেন। অভিনেতা অ্যালেক বল্ডউইনের সঙ্গে এর আগে কাজ করা অস্ত্র বিশেষজ্ঞ মাইক ত্রিস্তানো বলেন, ‘প্রত্যেক সেটেই মৌলিক কিছু সুরক্ষা নিয়ম থাকে। কখনো কারও দিকে বন্দুক তাক করা ঠিক নয়, সেটি গুলি ছোড়ার বন্দুক না হলেও না। আমি এটা ভেবে পাই না, এটা কেমন করে ঘটল এবং কী করে এতটা ক্ষতি হয়ে গেল।’ সিনেমার একটি প্রচলিত দৃশ্য আছে, যেখানে অভিনেতাকে ক্যামেরার দিকে গুলি ছুড়তে হয়। ফিউরি অ্যান্ড দ্য লিমিটেশন গেমের মতো সিনেমায় কাজ করা স্টিভেন হল জানান, পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়েই এটা করতে হয়। ‘আপনি যদি গোলাগুলির মাঝখানে থাকেন আপনাকে একটি মুখোশ পরতে হবে, চোখে চশমা পরতে হবে, পারস্পেক্স স্ক্রিনের পেছনে দাঁড়াতে হবে এবং আপনাকে ক্যামেরার আশপাশে লোকজন কমাতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এ ঘটনায় আমি যে বিষয়টি বুঝতে পারছি না তা হলো, দুজন লোক কীভাবে জখম হলেন, একজন তো মারাই গেলেন।’ চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত বাকিরা অবশ্য বলছেন, বন্দুকের ক্ষেত্রে যখন খুব সুলভে কম্পিউটার ‘ইফেক্ট’ ব্যবহার করা যায়, সেখানে এখনো কেন ‘ব্ল্যাংক কার্ট্রিজ’ ব্যবহার করা হচ্ছে। ‘ওয়েস্ট ওয়ার্ল্ড’ এবং ‘মেয়ার অব ইস্টটাউন’ সিনেমার পরিচালক ও অভিনেতা ক্রেইগ জোবেল এক টুইটে লিখেছেন, ‘বন্দুকে ব্ল্যাংক কার্ট্রিজ কিংবা অন্য কিছু ভরে সেটে ব্যবহার করার আর কোনো কারণই নেই। এটা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা উচিত।’

 
আরও যত দুর্ঘটনা

সিনেমার শুটিংয়ে প্রপস গানের কারণে নিহতের ঘটনা আগেও ঘটেছিল। ১৯৯৩ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। ‘দ্য ক্রো’ সিনেমার শুটিংয়ে ভুল করে ডামি গুলি ভরা একটি ‘প্রপস গান’ থেকে তার দিকে গুলি ছোড়া হয়। ডামি গুলিতে কোনো বিস্ফোরক থাকে না। ব্র্যান্ডন লির ক্ষেত্রে খুব কাছ থেকে তা ব্যবহার করা হয়েছিল। অস্ত্রে ব্ল্যাংক কার্ট্রিজ ভরার সময় ভুল করে ডামি গুলিও থেকে গিয়েছিল। ব্র্যান্ডন লিকে গুলি করার পরও ক্যামেরায় চিত্র ধারণ চলতে থাকে। ওই দৃশ্য ধারণ শেষ হওয়ার পরও তিনি যখন উঠলেন না, সেটের বাকিরা তখন বুঝতে পারলেন কিছু একটা গড়বড় হয়েছে।

১৯৮৪ সালে একটি টেলিভিশন শোর শুটিং শুরু করতে দেরি হওয়ায় মার্কিন অভিনেতা জন-এরিক হেক্সাম হতাশা জানিয়ে সেটে দাঁড়িয়ে কৌতুক করার সময় এরকম আরেকটি দুর্ঘটনা ঘটে। তিনি একটি রিভলবারে ব্ল্যাংক কার্ট্রিজ ভরে নলটি ঘুরিয়ে নিজের মাথায় ঠেকিয়ে ট্রিগার চেপে দেন। ব্র্যান্ডন লির মতো অস্ত্র থেকে নিক্ষিপ্ত ডামি গুলিতে তিনি মারা যাননি। বিস্ফোরণের কারণে তার মাথার খুলি ফেটে গিয়েছিল। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক দিন পর তিনি মারা যান।

বাংলা সিনেমার শুটিংয়ে অস্ত্র আসে কোথা থেকে

হলিউড-বলিউডের মতো ঢাকাই চলচ্চিত্রের অ্যাকশন দৃশ্যে ব্যবহার করা হয় অনেক প্রপস গান। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব প্রপস বা আগ্নেয়াস্ত্রগুলো থাকে নকল, কিন্তু দেখতে একেবারে আসলের মতো। মোহাম্মদ কামরুজ্জামান দীর্ঘদিন ধরেই এফডিসিতে প্রপস ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা করছেন। ১৯৯২ সাল থেকেই তিনি শুটিংয়ের জন্য অস্ত্র ও পোশাক সরবরাহ করে আসছেন। নিজে একটি ছবিতে অভিনয়ও করেছিলেন, পুলিশের চরিত্রে। সেটি অবশ্য প্রপসের ব্যবসা শুরুর আগে ১৯৮৮ সালে। এরপর থেকেই প্রোডাকশন ম্যানেজার আলী আজাদের সঙ্গে সহকারী হিসেবে ৪ বছর কাজ করেন কামরুজ্জামান। তার কাছ থেকেই মূলত কামরুজ্জামান প্রপসের ব্যবসা শেখেন এবং একপর্যায়ে তার কাছ থেকে সবকিছু কিনে নেন। স্বতন্ত্রভাবে তিনি ব্যবসা শুরু করেন ১৯৯২ সালে। তখন থেকেই তিনি শুধু অস্ত্র ও পোশাক সরবরাহ করতে থাকেন শুটিং ইউনিটগুলোতে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর