৯ এপ্রিল, ২০২০ ১৭:১৮

এখন লুকোচুরির সময় না, মানুষ গুলোকে বাঁচানোর সময়

আমিনুল ইসলাম

এখন লুকোচুরির সময় না, মানুষ গুলোকে বাঁচানোর সময়

আমিনুল ইসলাম

আজ বাংলাদেশে ১১২ জন নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। কতো দ্রুত এই সংখ্যা বাড়ছে সেটা নিশ্চয় এখন সবাই বুঝতে পারছে।

আমেরিকায় মৃত্যুর সংখ্যা এর মাঝেই স্পেনের মৃত্যু সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। অথচ মাত্র দেড় সপ্তাহ আগেও এরা মনের আনন্দে ঘুরে বেড়িয়েছে। এখন সেখানে মৃত্যুর মিছিল চলছে। আগামীকালের মাঝেই আমেরিকায় মৃত্যুর সংখ্যা ইতালিকেও ছাড়িয়ে যাবে। ইংল্যান্ডেও মৃত্যুর সংখ্যা কয়দিন পর ইতালি-স্পেনকে ছাড়িয়ে যাবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে ইংল্যান্ড-আমেরিকায় কেন মৃত্যুর সংখ্যা এতো বেশি?

প্রথম কারন-এরা চায়না, ইতালি-স্পেন থেকে শিক্ষা নেয়নি। এরা সবাই ঘুরে বেড়িয়েছে। যখন সব কিছু বন্ধ করেছে; অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে তখন।

দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে-এই দেশ গুলোতে, বিশেষ করে এদের বড় বড় শহর গুলোতে অনেক মানুষ এক সাথে বাস করে কিংবা ঘুরে বেড়ায়।

আমরা যখন এক মাস আগে বলেছিলাম-কারফিউ দিন, সব কিছু বন্ধ করে দিন; কেউ শুনেনি।
তো, আমাদের দেশেও এখন ভাইরাসটি ছড়িয়ে গিয়েছে। ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটি প্রান্তে এখন করোনা রোগী পাওয়া গিয়েছে। কারণ, আমরাও ঘুরে বেড়িয়েছি, এমনকি এখনও অনেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে! আমি জানি, বাংলাদেশের মতো দেশে সবাইকে ঘরে বন্দী করে রাখা কতো'টা কঠিন কাজ। সুতরাং আমি কাউকেই দোষ দিচ্ছি না। ভাইরাসটা যেহেতু ছড়িয়েই পড়ছে; এখন যা যা করতে হবে, সেটার দিকে নজর দেয়াই ভালো।

গত সপ্তাহেই লিখেছিলাম-এই ভারাস কোন বৈষম্য করে না। সবাইকেই আক্রমণ করে। ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী আজ তিন দিন হয় আইসিইউতে যুদ্ধ করছেন বেঁচে থাকার জন্য। আজ পত্রিকায় পড়লাম, সৌদি রাজ পরিবারের প্রায় ১৫০ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। আমি গত সপ্তাহে লিখেছিলাম- বাংলাদেশেও এমনটা হবে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ত করোনায় আক্রান্ত হবে। এর মাঝে মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে ডাক্তার-নার্সও থাকবে। তাই সব কিছুতেই আমাদের প্ল্যান "বি" তৈরি করে রাখতে হবে।

একজন না থাকলে, অন্য কে দায়িত্ব পালন করবে; কিভাবে পালন করবে; এই সব পরিকল্পনা যদি এখনও না করে থাকেন; তাহলে আজই করে ফেলুন। কারন যেই আক্রান্ত হবে; তাকেই কিন্তু ঘরে বসে থাকতে হবে। তার পক্ষে ঘুরে বেড়িয়ে কাজ করা সম্ভব হবে না। অনেকে হয়ত মোরেও যেতে পারে।
গতকাল রাতে জানতে পারলাম নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং পুলিশের এসপি কোয়ারেন্টাইনে গিয়েছেন। কারণ জেলা প্রশাসকের শরীরে করোনার লক্ষন দেখা দিয়েছে। তার নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। জানি না রেজাল্ট কি এসছে।

আমরা সবাই জানি, ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জ হচ্ছে হটস্পট। এই দুই শহরেই সব চাইতে বেশি করোনা রোগী পাওয়া গিয়েছে। তাহলে এখন নারায়ণগঞ্জ জেলার দায়িত্ব কে পালন করবে জেলা প্রশাসক যদি আইসোলেসনে থাকে? কিংবা পুলিশ সুপারের দায়িত্ব অন্য যেই পালন করুক; তাদের ভূমিকা কি হবে? কিভাবে সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে? দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তারাও আবার আক্রান্ত হতে পারে। তাই এইসব নিয়ে আজ এবং এক্ষুনি পরিষ্কার একটা প্ল্যান করে ফেলতে হবে এবং যদি সম্ভব হয় সাধারণ মানুষকে একটা ধারণা দিয়ে দিতে হবে।

গতকাল জানতে পারলাম সিলেটে এক ডাক্তার করোনায় আক্রান্ত হয়ে আইসিইউ সুবিধা পায়নি নিজেই। সেখানে নাকি কোন ভেন্টিলেটরও নেই। তাকে নাকি ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে! এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে তো ডাক্তাররা সবাই অসুস্থ হয়ে নিজেরাই হাসপাতালে পড়ে থাকবে। এই মুহূর্তে আমাদের এই ডাক্তারদের ছাড়া তো চলবে না কোন ভাবেই।

আজ খানিক আগে আপনাদের মন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন-সকল বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এখন থেকে সকল রোগীকে চিকিৎসা দিবে। এই বিষয়টা পরিষ্কার করার জন্য ধন্যবাদ। আমি চার দিন আগেই পত্রিকায় লিখেছিলাম, সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতাল গুলোকে সমন্বয় করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে-ডাক্তার, নার্স কিংবা ওয়ার্ড বয়রা কি সব রকম সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে? আমার আপন বোনের মেয়ে, মানে আমার ভাগ্নি ডাক্তার; তার অনেক বন্ধু-বান্ধব ডাক্তার। এরা অনেকে আমাকে গতকাল মেসেজ করে লিখেছে-তাদের আসলে কোন সুযোগ সুবিধাই দেয়া হচ্ছে না।

ডাক্তাররা প্রটেক্টটিভ ইকুইপমেন্ট পেলে, নার্সরা পাচ্ছেন না; আবার নার্সরা পেলে ওয়ার্ড বয়রা পাচ্ছে না! এছাড়া ইকুইপমেন্টের সংখ্যাও অনেক কম। ঢাকার বাইরের অনেক ডাক্তারদের নাকি বাড়িওয়ালারা বের করে দিচ্ছে। অনেক ডাক্তারদের নাকি এমনকি কাজে যেতে সমস্যা হচ্ছে লকডাউন থাকাতে। অনেকে পায়ে হেঁটেও ঠিক মতো যেতে পারছে না; জায়গায় জায়গায় নাকি নাজেহাল হতে হচ্ছে।

আমি কাউকে দোষারোপ করছি না। কিন্তু এই সমস্যা গুলো মেটাতে না পারলে ডাক্তাররা স্বাচ্ছন্দ্যে চিকিৎসা করতে পারবে না। আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। গতকাল আমি প্রাইভেট মেডিকেল গুলো নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম; আজ আপনাদের মন্ত্রী এসে নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন-সব প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা দেয়া হবে। কিন্তু সেই সঙ্গে সকল ডাক্তার'; সেটা সরকারি কিংবা বেসরকারি ডাক্তারদের সুযোগ সুবিধা গুলো নিশ্চিত করুন।

শুধু ডাক্তারদের সুযোগ সুবিধা না; নার্স, ওয়ার্ড বয় থেকে শুরু করে; হাসপাতালে যারাই কাজ করে; সবার সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। নইলে তো ওয়ার্ড বয় করোনায় আক্রান্ত হয়ে অন্য সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারে। এই রোগ তো কাউকেই ছাড়ছে না।

গতকাল ডাক্তারদের নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম; তারা দল বেধে এসে আমার সমালোচনা করেছে। সমালোচনা করুক তারা। এতেও যদি সুযোগ সুবিধা গুলো নিশ্চিত হয়; মানুষ গুলো যদি বেঁচে যায়; আমার আপত্তি নেই। তারা আমার সমালোচনা করতে থাকুক। আমি জানি পৃথিবীর সব চাইতে উন্নত দেশ গুলোও পারছে না ডাক্তারদেরকে সব সুযোগ সুবিধা দিতে। ইকুইপমেন্টেরও অভাব আছে। কিন্তু এর মাঝেও সর্বোচ্চ চেষ্টা টুকু করতে হবে।

ডাক্তারদের নেতারা এসে সরকারকে তেল দেয়ার জন্য বলবে সব কিছু ঠিক আছে; আর যেই ডাক্তাররা ফ্রন্ট লাইনে কাজ করছে, তাদের কাছে আসলে কিছুই নেই; এমনটা যেন না হয়। না থাকলে; সোজা বলে দিন-আমাদের অভাব আছে; আমরা চেষ্টা করছি যতটা সম্ভব সাপ্লাই জোগাড় করার। উন্নত দেশরাই তো পারছে না; সেখানে আপনারা সব কিছু পেয়ে যাবেন; এমন তো না। তাই না থাকলে সেটা বলে দিন। নইলে যেটা হবে-আপনাদের নিজেদের মাঝেই ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হবে। এর কোনই দরকার নেই। এখন লুকোচুরির সময় না। এখন সময় মানুষ গুলোকে বাঁচানোর।

তবে একটা কথা বলে নেই- যতই হাসপাতালের সংখ্যা বাড়ান; ডাক্তার-নার্সের সংখ্যা বাড়ান কিংবা ইকুইপমেন্টের সংখ্যা বাড়ান; এরত কিন্তু শেষ রক্ষা হবে না। কারণ এই রোগ খুব দ্রুত ছড়ায়। আজ ১১২ জন। এক সপ্তাহ পর দেখবেন ১০ হাজার জন। দুই সপ্তাহ পর লাখ ছাড়িয়ে যাবে। এতো রোগীকে কি এক সাথে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব? অবশ্য'ই না। এই জন্য এই রোগের সব চাইতে ভালো চিকিৎসা হচ্ছে মানুষ গুলোকে যেভাবেই সম্ভব ঘরে বেঁধে রাখা। এতে করে রোগটা দ্রুত ছড়াবে কম। এটা অতি অবশ্যই ছড়াবে। কিন্তু দ্রুত ছড়াবে না যদি সবাই বাসায় থাকি।

এখন বাংলাদেশ যেই স্টেজে আছে; এটা ছড়িয়ে গিয়েছে এবং ছড়াতেই থাকবে। এর মাঝে যাতে খুব দ্রুত না ছড়ায়; যাতে হাসপাতাল গুলোতে জায়গা সংকুলান হয়; যাতে ডাক্তার কিংবা স্বাস্থ্য কর্মীরা অন্তত চিকিৎসা টুকু দিতে পারে; এর জন্য আমাদের সবাইকে ঘরে থাকতে হবে। এতে করে ছড়িয়ে যাবার গতি কিছুটা কমবে। মানুষ গুলো যাতে কোন ভাবেই বের না হয়। দরকার হয় কারফিউ দিন।
কাল জানতে পারলাম অগ্রণী ব্যাংকের এক কর্মকর্তা আক্রান্ত হয়েছেন। আমি জানি দেশের অর্থনীতি সচল রাখার জন্য ব্যাংক গুলো চালু রাখার দরকার। কিন্তু এই জরুরি প্রয়োজনে সকল ব্যাংকের সকল শাখা খোলা রাখা আসলে কতোটা যৌক্তিক? এছাড়া আরো অনেক কল-কারখানা খোলা আছে। খাদ্য, ওষুধ সামগ্রী অথবা জরুরি প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া আর কোনো কিছুর সাথে সম্পৃক্ত কিছুই খোলা রাখার দরকার নেই।

মানুষ চিড়া-মুড়ি খেয়েও দিনের পর দিন বেঁচে থাকতে পারে। অন্তত এই খাবার গুলো, যারা দরিদ্র, যাদের পক্ষে এটাও জোগাড় করা সম্ভব না; তাদের পৌঁছে দিন। বাদ বাকী সবাই নিজেদের মতো করে খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকবে। পোলাউ-কোর্মা খাবার দরকার নেই। চিড়া-মুড়ি খেয়ে দিন পার করুন।
আবারও বলছি- এটা ভয়াবহ যুদ্ধ। আমেরিকা যদি আজ বাংলাদেশ আক্রমণ করতো; আমরা নিশ্চয় বসে থাকতাম না; নিজ দেশকে শত্রু'র হাত থেকে বাঁচানোর জন্য আমি মোটামুটি নিশ্চিত সকল ভেদাভেদ ভুলে আমরা সবাই ঝাপিয়ে পড়তাম।

সমস্যাটা এখানেই। এই যুদ্ধে যে শত্রুকে দেখা যাচ্ছে না। তবে এই শত্রু আমেরিকার চাইতেও শক্তিশালী শত্রু। এই শত্রু মুহূর্তে দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে রাজা-মহারাজাকে আক্রমণ করে বসতে পারে। তাই আমাদের যতটুকু সামর্থ্য আছে; সেই সামর্থ্য নিয়েই ঝাপিয়ে পড়তে হবে।
আমাদের বাসায় থাকতে হবে এবং বাসাতেই থাকতে হবে। এর মাঝেই আমরা বিশাল বড় ভুল করে ফেলেছি। এর ভুলের মাশুল যাতে আমাদের খুব বেশি দিতে না হয়; এই জন্য ঘরে থাকতে হবে। আমরা যখন এক মাসে আগে লিখেছি, শুনেন নাই। এখন অন্তত শুনুন। দরকার হয় সোজা কারফিউ দিয়ে দিন। নইলে বাংলাদেশের মতো দেশের ভাগ্যে কি অপেক্ষা করছে এক মাত্র সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন।
ইংল্যান্ড-আমেরিকায় কিন্তু বাংলাদেশি কমিউনিটির মাঝে এই রোগ খুব বেশি পরিমাণে ছড়িয়েছে।
এর কারণ আমাদের জীবন-যাত্রা। আমরা এক সঙ্গে দল বেধে চলতে পছন্দ করি। আড্ডা দিতে পছন্দ করি। আমিতো মনে করি-এটাই আমাদের চমৎকার বৈশিষ্ট্য। আমারা যেন দেশে আবার সবাই বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, প্রিয়জন মিলে এক সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে পারি; চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে পারি; বিয়ে বাড়িতে আনন্দ-উৎসব করতে পারি; সবাই মিলে যে যার ধর্মীয় উপাসনালয়য়ে যেতে পারি; ঈদের সময় দল বেধে বাড়ি যেতে পারি অন্তত এই জন্য হলেও এখন আমাদের সবাইকে ঘরে থাকতে হবে।
নইলে হয়ত আমারা আমাদের মাঝে অনেক প্রয়োজনকে হারিয়ে ফেলব। তখন হয়ত বেঁচে থেকেও এই আড্ডা গুলোকে আর আড্ডা মনে হবে না। 

তাই মানুষ গুলোকে ঘরে বন্দী করে রাখুন। স্রেফ ধরে নিন-আমেরিকা কিংবা রাশিয়া আকাশ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র মারছে। ঘরের বাইরে গেলেই নিশ্চিত মৃত্যু।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর