বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

দুর্নীতির শীর্ষে পাসপোর্ট ও পুলিশ

সেবা খাতে দুর্নীতি ৮ হাজার ৮২১ কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক

দুর্নীতির শীর্ষে পাসপোর্ট ও পুলিশ

দেশের সেবা খাতগুলোর মধ্যে পাসপোর্ট বিভাগ সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত। প্রায় ৭৭ শতাংশ মানুষকে এখান থেকে সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতি ও ঘুষের শিকার হতে হয়েছে। গতকাল রাজধানীর ধানমন্ডিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ‘সেবা খাতে দুর্নীতি, জাতীয় খানা জরিপ-২০১৫’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশের ১৫ হাজার পরিবারের ওপর পরিচালিত জরিপে এ রিপোর্ট তৈরি করা হয়। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন সেবা খাতে মানুষ দুর্নীতির শিকার হয় বলে দাবি করেছে টিআইবি। সংস্থাটি বলছে, এ খাতের মধ্যে পরের অবস্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ সংস্থায় দুর্নীতির শিকার হন ৭৪.৬ শতাংশ, শিক্ষায় ৬০.৮ শতাংশ মানুষ। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পাসপোর্ট, বিচারিকসহ অন্তত ১৬টি খাতের সেবা পেতে বছরে ৮ হাজার ৮২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয় বলে টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। টিআইবির চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল রিপোর্ট তুলে ধরেন। প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০১৫ সালে প্রাক্কলিত মোট ঘুষের পরিমাণ ৮ হাজার ৮২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা; যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটের ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষা সংস্থায় দুর্নীতির শিকার হন ৭৪ দশমিক ৬ শতাংশ, শিক্ষায় ৬০ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ। উচ্চ আয়ের তুলনায় নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর দুর্নীতি ও ঘুষের বোঝা অনেক বেশি। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন টিআইবির চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল, নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, উপনির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া খায়ের। নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সেবা খাতে ২০১৫ সালের জাতীয় প্রাক্কলিত ঘুষের পরিমাণ ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ৩ দশমিক ৭ শতাংশ ও জিডিপির শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১২ সালে সেবা খাতের দুর্নীতি জরিপের তুলনায় এবার ১ হাজার ৪৯৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা বেশি ঘুষ দিতে হয়েছে। ২০১২ সালের তুলনায় এবার মানুষের দুর্নীতির শিকারের হার প্রায় ১ শতাংশ ও ঘুষের শিকারের হার ৬ শতাংশ বেড়েছে। সেবা খাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি ও ঘুষের শিকার হতে হয় পাসপোর্ট খাতে। পাসপোর্ট সেবা নিতে ৭৭ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ দুর্নীতির শিকার ও ৭৬ দশমিক ১ শতাংশ মানুষকে ঘুষ দিতে হয়। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। এ ছাড়া শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে দুর্নীতির প্রকোপ বেশি ও ঘুষের শিকারও হতে হয় বেশি। তিনি বলেন, খানা জরিপে উঠে এসেছে, ঘুষ না দিলে কাঙ্ক্ষিত সেবা পান না ৭১ শতাংশ খানার সদস্য। দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা উদ্বেগজনক। দুর্নীতি এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার প্রবণতা থাকায় দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্ভব হচ্ছে না। আশা করি, আগামীতে কার্যকর আরও উদ্যোগ নেওয়া হবে। সংবাদ সম্মেলনে দুর্নীতি রোধে নিয়োগ, পদোন্নতি এবং বদলিতে দলীয়করণ ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অবসান ঘটিয়ে সব খাতে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতের সুপারিশ করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক।

টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেন, ‘দুর্নীতির ব্যাপকতার উদ্বেগের অন্যতম কারণ হচ্ছে, মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে জড়িয়ে পড়েছে দুর্নীতি। দুর্নীতিবিহীন জীবনযাপন যেন সম্ভব নয়। এটা নৈতিকতার ওপর বড় হামলা। দেশের শীর্ষ পর্যায়ে যদি দুর্নীতিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া না হয় ও দুর্নীতিকে অস্বীকার বা লুকানোর চেষ্টা করা না হয় এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে দুর্নীতির চক্র থেকে বের হয়ে আসতে পারব।’ সম্মেলনে জানানো হয়, ১৯৯৭ সাল থেকে টিআইবি এ পর্যন্ত সাতটি খানা জরিপ করেছে। সর্বশেষ ২০১২ সালে এ জরিপ করা হয়েছিল। ২০১৪ সালের নভেম্বর থেকে গত অক্টোবর পর্যন্ত সেবার ওপর ভিত্তি করে গত ১ নভেম্বর থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এর আওতায় ১৫ হাজার ২০৬টি খানা ছিল, যা দেশের মোট খানার ২১০০ ভাগের ১ ভাগ। এবার দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় গুরুত্ব ও প্রভাব বিবেচনায় ১৫টি প্রধান খাতকে জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে ছিল স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, ভূমি প্রশাসন, কৃষি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিচারিক সেবা, বিদ্যুৎ, ব্যাংকিং, কর ও শুল্ক, এনজিও, পাসপোর্ট, গ্যাস, বিআরটিএ ও বীমা। এ ছাড়া অন্যান্য নামে ওয়াসা, বিটিসিএল ও ডাকের সেবা খাতকে বিবেচনায় নেওয়া হয় জরিপে। সম্মেলনে মূল প্রতিবেদনের সারাংশ উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. ওয়াহিদ আলম, প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফারহানা রহমান ও ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোহাম্মদ নূরে আলম।

দুর্নীতি-ঘুষের তুলনামূলক চিত্র : জাতীয় খানা জরিপের সার্বিক বিশ্লেষণ তুলে ধরে অনুষ্ঠানে টিআইবি আরও জানায়, ২০১৫ সালে সেবা খাতে ঘুষের শিকার হওয়ার হার ২০১২ সালের তুলনায় বেড়েছে (৫৮.১% বনাম ৫১.৮%)। তবে সার্বিকভাবে অনিয়ম-দুর্নীতির হার প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে ভূমি প্রশাসন, বিচারিক সেবা, স্বাস্থ্য, ব্যাংকিং, এনজিও ও অন্যান্য খাতে দুর্নীতি কমেছে। কিন্তু স্থানীয় সরকার, বিদ্যুৎ ও বীমা খাতে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, কৃষি, কর ও শুল্ক খাতে দুর্নীতির হার প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। স্বাস্থ্য, বিচারিক সেবা, ভূমি প্রশাসনসহ ছয়টি খাতে ঘুষের শিকার খানার হার ২০১২ সালের তুলনায় কমেছে। তবে শিক্ষা, বিদ্যুৎ ও এনজিওর ক্ষেত্রে এ হার বেড়েছে। ঘুষের হার অপরিবর্তিত রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, কৃষি, কর এবং শুল্ক ও অন্যান্য খাতে। শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে সেবা খাতে দুর্নীতির প্রকোপ বেশি; ঘুষ প্রদানে বাধ্য হওয়ার হারও বেশি। জরিপে দেখা গেছে, গ্যাসের সংযোগ নিতে গিয়ে খানাকে সবচেয়ে বেশি ঘুষ দিতে হয়েছে; যার গড় পরিমাণ ২৭ হাজার ১৬৬ টাকা। আর বীমা খাতে দিতে হয়েছে ১৩ হাজার ৪৬৫, বিচারিক সেবায় ৯ হাজার ৬৮৬ ও ভূমি প্রশাসনে ৯ হাজার ২৫৭ টাকা।

সর্বশেষ খবর