প্রতি বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরে ময়মনসিংহের ভালুকার রেপটাইলস ফার্ম থেকে কুমিরের চামড়া রপ্তানি হতো। প্রকারভেদে সেই চামড়া প্রতিটি ২০০ থেকে ৬০০ ডলারে বিক্রিও হতো। কিন্তু গত বছর রপ্তানি হয়নি। অথচ রপ্তানিযোগ্য কুমিরের চামড়া ছিল প্রায় ৫৫০টি। কেন রপ্তানি হয়নি? এমন প্রশ্নের জবাবে খামারের ব্যবস্থাপক আবু সাইম আরিফ জানান, ‘কভিড পরিস্থিতির কারণে সম্ভব হয়নি রপ্তানি। এর আগে পাঁচবার কুমিরের চামড়া রপ্তানি করা হয়। বাংলাদেশি টাকায় যার মূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা।’ তবে বাস্তব বলছে ভিন্ন কথা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৩ সালের দিকে নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর রেপটাইলস ফার্মের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ বের করে নেন প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদার, যা আর শোধ হচ্ছে না। ফলে গত বছর অপ্রচলিত এ পণ্য আর রপ্তানি সম্ভব হয়নি। এমনকি চলতি বছরের তিন মাস চললেও কোনো উদ্যোগ নেই কুমির রপ্তানির। উল্টো বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ২৫ একরের এ ফার্মটিতে। সরেজমিন ভালুকার উথুরা ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠিত ওই খামারটিতে গিয়ে জানা যায়, বর্তমানে ছোট-বড় মিলিয়ে কুমির রয়েছে ২ হাজার ৮০০র বেশি। এর মধ্যে প্রজননক্ষম কুমির আছে ১২০টি। কুমিরের খাবারের জন্য রয়েছে একটি মুরগির ফার্মও। জানা যায়, বিশ্ববাজারে চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৪ সালে ময়মনসিংহের ভালুকায় শুরু হয় কুমির চাষ। এর আরও দুই বছর আগে বন্যপ্রাণী নিয়ে কিছু করার ভাবনা আসে মুশতাক আহমেদের। কুমিরের প্রতি আলাদা আগ্রহ জন্মানো তখনকার ওই তরুণ তা প্রতিষ্ঠাও করেন। যা ছিল সমগ্র এশিয়ার মধ্যেই প্রথম বাণিজ্যিক কুমির খামার প্রকল্প। পরে ২০১০ সালে কুমিরের খামার ও কুমির রপ্তানি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন মুশতাক। সেই মুশতাক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলায় সম্প্রতি বন্দীদশায়ই মারা যান। তবে যে স্বপ্ন থেকে মুশতাক কুমিরের খামার শুরু করেছিলেন, ২০১০ সালে জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম রপ্তানির পর থেকেই সেই স্বপ্ন ধীরে ধীরে ফিঁকে হতে থাকে। একপর্যায়ে প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদারের কাছে খামারের মালিকানা হারান মুশতাক আহমেদ। এর কারণ নিয়ে রেপটাইলস ফার্মের বিষয়ে বিভিন্ন অনুসন্ধান করে জানা যায়, প্রতিষ্ঠার শুরুতে ৩৬ শতাংশ শেয়ার ছিল মেজবাহুল হকের। যিনি সম্পর্কে মুশতাক আহমেদের মামা। আর ১৫ শতাংশ শেয়ার ছিল মুশতাক আহমেদের। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইইএফ প্রকল্পের ঋণ নেওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শেয়ার ছিল ৪৯ শতাংশ। সেই হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি ব্যাংক কর্মকর্তা প্রিতিশ কুমার সরকার ছিলেন পরিচালক। এরপরও কুমিরের খাবার, বাচ্চা প্রজনন ও পরিচর্যার কাজে মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ প্রয়োজন পড়ে। তখনই মেজবাহুল হক ও মুশতাক আহমেদের মধ্যে মতপার্থক্য বাড়তে থাকে। যা বাংলাদেশ ব্যাংক ও আদালত পর্যন্ত গড়ায়। ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রিতিশ কুমার সরকারের পক্ষ থেকে মুশতাক আহমেদকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়, ‘৩০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের শেয়ার কিনে নেওয়ার জন্য টাকা জমা দিতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ৪৯ শতাংশ শেয়ারের পুরোটাই মেজবাহুল হকের নামে হস্তান্তর করা হবে।’ তখনই প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদারের সঙ্গে প্রিতিশ কুমার সরকারই মেজবাহুল হক ও মুশতাক আহমেদের যোগাযোগ ঘটিয়ে দেন। একপর্যায়ে ২০১২ সালে বাধ্য হয়েই খামারের শেয়ার ছাড়তে বাধ্য হন কুমির খামারের স্বপ্নদ্রষ্টা মুশতাক আহমেদ। তবে অর্থ সংকটে থাকলেও খামারের মালিকানা ছাড়তে চাননি তিনি। ২০২০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মুশতাক আহমেদের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে এমনটিই ইঙ্গিত মেলে।
এরপরই প্রতিষ্ঠানটির নামে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ বের করে নেন পি কে হালদার। বর্তমানে খামারের মালিকানার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল, কেএইচবি সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাজীব সোম ও তার স্ত্রী শিশু রায়। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝতে পেরে তারাও গা ঢাকা দিয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে এই দম্পতি বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ‘বাংলাদেশ থেকে রপ্তানির তালিকায় নতুন সম্ভাবনার নাম কুমির। একটি দুষ্টচক্রের কারণে ঋণের জাঁতাকলে এই সম্ভাবনাময় খাতটি ধ্বংস হতে পারে না। আশা করছি, প্রয়োজনে সরকারি হস্তক্ষেপে বর্তমান সংকট কাটিয়ে উঠে আবার কুমির রপ্তানি করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।’