সোমবার, ১৭ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

এসপি বাবুলের পরকীয়ার বলি মিতু! জিজ্ঞাসাবাদে করছেন বিভ্রান্ত

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

এসপি বাবুলের পরকীয়ার বলি মিতু! জিজ্ঞাসাবাদে করছেন বিভ্রান্ত

বাবুল আক্তার ও মাহমুদা খানম মিতু

স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুর খুনের খবর পেয়ে ঢাকা থেকে অঝোরে কেঁদে কেঁদে হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রামে আসেন সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার। এ কান্না অব্যাহত ছিল মেডিকেল থেকে জানাজা পর্যন্ত। বাবুলের চোখের জলে আবেগাপ্লুত হয় আপামর জনগণ। মিতু খুনের পাঁচ বছর পর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে উঠে এসেছে বাবুলের কান্নার দৃশ্য ছিল পুরোটাই ‘মেকি’। স্ত্রীকে খুন করিয়ে ঘটনা ভিন্ন খাতে ঘোরানোর জন্যই ওই দিন এমন আবহ তৈরি করেন বাবুল। স্ত্রীকে খুন করার পর সহানুভূতি পাওয়ার চেষ্টা করেন নানাভাবে। কিন্তু পিবিআইর তদন্তে উল্টে গেল মামলার গতি। বাদীর ভূমিকা থেকে আসামির কাঠগড়ায় সাবেক এ পুলিশ সুপার।

মিতুকে খুনের অভিযোগে বুধবার চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় খুনের মামলা দায়ের করেন মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন, যাতে প্রধান আসামি করা হয় স্বামী বাবুল আক্তারকে। মামলার অন্য সাত আসামি বাবুল আক্তারের ঘনিষ্ঠ সোর্স হিসেবে পরিচিত। স্ত্রী হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানোর পর বাবুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য নেয় তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই। তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের দাবি, বাবুল জিজ্ঞাসাবাদে তাদের বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছেন। নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছেন তিনি।

মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘মিতু খুনের পর বাবুল এমন অভিনয় করেছে বোঝার উপায় ছিল না এ খুনের সঙ্গে সে জড়িত। মিতুকে কবর দেওয়ার সময় পারলে বাবুলও কবরে যাওয়ার আবহ তৈরি করেছিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে আমাদের সেই ভুল ভাঙে। এরপর থেকে বিভিন্ন জায়গায় বাবুল এ খুনের সঙ্গে সম্পৃক্ত তা বলে আসছি। আমাদের দাবি সঠিক ছিল তা পিবিআইর তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে।’ পিবিআইর পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, ‘মামলার তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর বাদী বাবুলের ওপরও নজর ছিল। বাবুল আক্তারের এ খুনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা পাওয়ায় আগের মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। নতুন মামলায় তাকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।’

জানা যায়, মিতু হত্যা মামলায় বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত হওয়ার পর গ্রেফতারের দুই দিন আগে পিবিআইর হেফাজতে নেওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তাকে মিতু হত্যাকান্ডের বিষয়ে নানা প্রশ্ন করা হলেও সিংহভাগ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। এর আগে এ খুনের বেশ কিছু তথ্যপ্রমাণ আসে মামলার তদন্তকারী সংস্থার হাতে, যার মধ্যে বাবুল আক্তারের একটি ফোন রেকর্ড এবং কিছু দালিলিক প্রমাণ ছিল। সঙ্গে ছিল বাবুলের দুই ব্যবসায়িক অংশীদার সাইফুল হক এবং গাজী আল মামুনের দেওয়া তথ্য। বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত হওয়ার পর ঊর্ধ্বতন মহলে অবহিত করে প্রথম হত্যা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে নতুন করে মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে মিতুর বাবা বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় নতুন করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। মামলার বাকি সাত আসামি হলেন- মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা, এহতেশামুল হক প্রকাশ হানিফুল হক প্রকাশ ভোলাইয়া, মো. মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খাইরুল ইসলাম কালু, মো. সাইদুল ইসলাম সিকদার সাক্কু ও শাহজাহান মিয়া।

বাবুলের পরকীয়ার বলি মিতু : সাবেক পুলিশ সুপার বাবুলের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের বলি হয়েছেন স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু। এ খুনের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে তা বাস্তবায়ন সবকিছুই তদারক করেছেন বাবুল নিজেই। এমনকি কিলিং মিশন শেষ হওয়ার পর অংশগ্রহণকারীদের নগদ ৩ লাখ টাকাও দেন। মিতু হত্যার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলা এবং পিবিআইর দেওয়া অপর মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়। পাঁচলাইশ থানায় দায়ের হওয়া মামলায় উল্লেখ করা হয়, বাবুল আক্তার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কক্সবাজার থাকাকালে ইউএনএইচসিআরের ফিল্ড অফিসার গায়ত্রী অমর সিংয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। তারা পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। ২০১৪ থেকে ২০১৫ সালে সুদানে মিশনে যাওয়ার সময় বাবুল আক্তার মোবাইল বাসায় রেখে যান। এ সময় গায়ত্রী বিভিন্ন সময় মোবাইলে ২৯টি মেসেজ পাঠান। হত্যাকান্ডের কয়েক মাস আগে বাবুল আক্তার চীনে প্রশিক্ষণের জন্য যান। এ সময় গায়ত্রীর উপহার দেওয়া ‘তালিবান’ এবং ‘বেস্ট কেপ্ট সিক্রেট’ বই দুটি পান। এতে তালিবান বইয়ের তৃতীয় পৃষ্ঠায় গায়ত্রী লেখেন, ‘Coxsbazar, Bangladesh. Hope the memory of my offering you this personal gift, shall eternalize our wonderful bound, love you, Gaitree’. একই বইয়ের ২৭৬ নম্বর পৃষ্ঠায় বাবুল আক্তার লেখেন- ‘First meet: 11 Sept, 2013, First PR in Cox. 07 Oct 2013. G Birth Day, 10 October, First (——): 05 Oct 2013; First beach walk: 8th Oct, 2013, 11 Oct 2013, Mermaid with family, 12 Oct 013, Temple Ramu Prayed Together, 13 Oct 2013; Ramu Rubber Garden Chakaria night beach walk’. বাবুল ও গায়ত্রীর পরকীয়ার প্রতিবাদ করায় পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় মিতুকে। মিতু হত্যকান্ডে বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততার তথ্য উঠেছে পিবিআইর দেওয়া আরেক মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন ও বাবুল আক্তারের ব্যবসায়িক অংশীদার সাইফুল হক এবং গাজী আল মামুনের সাক্ষী হিসেবে আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে। মঙ্গলবার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শফিউদ্দিনের আদালতে জবানবন্দি দেন তারা। ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, ‘স্ত্রী হত্যার তিন দিন পর বাবুল তার ব্যবসায়িক অংশীদার সাইফুল হককে লাভের অংশ থেকে ৩ লাখ টাকা দেওয়ার জন্য বলেন। সাইফুল বিকাশের মাধ্যমে ওই টাকা গাজী আল মামুনকে পাঠান। পরে মামুন ওই টাকা মুসা, ওয়াসিমসহ অন্য আসামিদের ভাগ করে দেন।’ মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘কক্সবাজার থাকাকালে এনজিও কর্মকর্তা ভারতীয় নাগরিক গায়ত্রী অমর সিংয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে বাবুলের। তাদের পরকীয়ার বিষয় জেনে যাওয়ার পর মিতুর সঙ্গে পারিবারিক কলহ শুরু হয়। এ সময় বাবুল শারীরিক ও মানসিকভাবে মিতুকে নির্যাতন শুরু করে। আবার মিতুকে গায়ত্রী খুনের হুমকিও দেন। বাবুল পথের কাঁটা দূর করতে মিতুকে খুনের পরিকল্পনা করে। নিজের লোকজন দিয়ে মিতুকে খুন করে।’

বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে বাবুল : স্ত্রী খুনের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া সাবেক পুলিশ সুপার বাবুুল আক্তার মামলার তদন্ত সংস্থা পিবিআইকে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন। এতে করে জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানান, পেশাগত জীবনে চৌকস অফিসার হওয়ায় বাবুল আক্তার জানেন কীভাবে জিজ্ঞাসাবাদে বিভ্রান্ত করতে হয়। তাই জিজ্ঞাসাবাদে পথে পথে বিভ্রান্ত করছেন তিনি। এ বিভ্রান্তির শুরুটা হয় মামলার এজাহার লেখার মাধ্যমে। পিবিআই হেফাজতে নেওয়ার পর বর্তমান ঠিকানা দেওয়ার জন্য বলা হয় বাবুল আক্তারকে। কিন্তু বাবুল মোহাম্মদপুরের যে সড়ক ও হোল্ডিং নম্বর দেন তা ছিল সম্পূর্ণ ভুল। পরে বাবুল আক্তারের গাড়িচালকের সহায়তায় তার বর্তমান বাসা শনাক্ত করা হয়। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কোনো তথ্য জিজ্ঞাসা করলে বাবুল আক্তার বলেন, আমার নার্ভ খুবই শক্ত। সহজে আমাকে ভাঙতে পারবা না। পরক্ষণেই তিনি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন।’ প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৫ জুন নগরীর জিইসির মোড় এলাকায় ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে খুন হন সাবেক এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু।

সন্তানদের জিম্মা নিতে চান নানা : সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার ও মাহমুদা খানম মিতু দুই সন্তানের জিম্মা নিতে চান নানা মোশাররফ হোসেন। নাতি-নাতনির জিম্মা আবেদন করতে গতকাল আদালতেও যান তিনি। কিন্তু করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আবেদন করতে পারেননি।

মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘মিতু সন্তানদের দুজনই অপ্রাপ্ত বয়স্ক। মা পাঁচ বছর আগে খুন হয়েছেন। সেই খুনের দায়ে বাবুল এখন গ্রেফতার। তাই তাদের দেখাশোনা করার মতো বিশ্বস্ত কেউ নেই। তাদের দেখাশোনার দায়দায়িত্ব আমরা নিতে চাই। আদালতে মাধ্যমে জিম্মা নিতে আবেদন করতে গেছিলাম। আদালত বন্ধ থাকায় আবেদন করতে পারিনি। আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে তাদের জিম্মা নেওয়ার জন্য আবেদন করব।’ তিনি বলেন, ‘মিতু খুনের একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী মাহির। বাবুলের পরিবারের কাছে থাকলে তার নিরাপত্তা হুমকিতে পড়তে পারে। তাই তাদের জিম্মা আমাদের কাছে দেওয়া জরুরি।’ প্রসঙ্গত, মিতু খুন হওয়ার সময় বাবুলের ছেলেসন্তান মাহির মাহমুদের বয়স ছিল ১২ বছর এবং মেয়ে তাবাসসুমের বয়স ছিল সাত বছর। খুনের পরপর দুই সন্তানকে নিয়ে ঢাকার মেরাদিয়ার শ্বশুরবাড়ির বাসায় ওঠেন বাবুল। ওই খানে কিছুদিন থাকার পর ভাড়া বাসায় যান বাবুল। এর মধ্যেই শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে তার। এরপর গত সাড়ে তিন বছরে মিতুর দুই সন্তানের সঙ্গে দেখাই হয়নি নানা-নানির।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর