শিরোনাম
সোমবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

নৌশ্রমিক ধর্মঘটে ব্যাপক ভোগান্তি

পণ্য পরিবহন বন্ধ, কার্যক্রম ব্যাহত বন্দরের, লঞ্চশূন্য সদরঘাট

নিজস্ব প্রতিবেদক

নৌশ্রমিক ধর্মঘটে ব্যাপক ভোগান্তি

চিকিৎসা করাতে এসে গতকাল নৌশ্রমিক ধর্মঘটের কারণে সদরঘাটে আটকা পড়েছে এ পরিবারটি -বাংলাদেশ প্রতিদিন

ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজার টাকা, কর্মক্ষেত্রে মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ ১২ লাখ টাকা করাসহ ১০ দাবি আদায়ে সারা দেশে লাগাতার ধর্মঘট শুরু করেছেন নৌযান শ্রমিকরা। এ ধর্মঘটে দেশের অভ্যন্তরীণ নৌবন্দরগুলো লঞ্চশূন্য হয়ে পড়েছে। ফলে ভোগান্তিতে পড়েছেন নৌপথে যাতায়াতকারী যাত্রীরা। এদিকে নৌশ্রমিকদের ধর্মঘটে যাত্রী ভোগান্তি, পণ্য পরিবহন বন্ধ, বন্দরের কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর ও বাগেরহাটের মোংলা বন্দরে। গত শনিবার রাত ১২টা থেকে এ ধর্মঘট শুরু করেন শ্রমিকরা।

যদিও ধর্মঘট প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ট্যাংকার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। একই সঙ্গে বেআইনিভাবে ধর্মঘট ঢাকায় নৌশ্রমিক ফেডারেশনসহ সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। গতকাল সকাল থেকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌবন্দর সদরঘাটে ঘুরে দেখা গেছে, বৃহত্তম এ বন্দরটি লঞ্চশূন্য হয়ে আছে। দুই শতাধিক লঞ্চের মধ্যে ঢাকা থেকে বিভিন্ন নৌপথে প্রতিদিন প্রায় ৬০ থেকে ৬৫টি লঞ্চ চলাচল করলেও এদিন প্লাটুনে কোনো লঞ্চের দেখা মেলেনি। নৌশ্রমিকরা লঞ্চগুলো নিয়ে মাঝ নদীতে সারিসারি রেখে অবস্থান নিয়েছেন। নৌশ্রমিকদের এ ধর্মঘটে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা। সদরঘাট থেকে দক্ষিণ অঞ্চলে যাতায়াতকারী বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীরা পড়েন চরম বিপাকে। ধর্মঘটের খবর না জানায় প্রতিদিনের মতো অনেক যাত্রী আসেন সদরঘাটে। কেউ ফিরে যান, আবার কেউ অপেক্ষা করতে থাকেন লঞ্চ চলার অপেক্ষায়। এমনই একজন যাত্রী বকুল হোসেন। চাঁদপুর যাওয়ার উদ্দেশে সকালে সদরঘাটে আসেন তিনি। পরে জানতে পারেন লঞ্চ শ্রমিকদের ধর্মঘট। বাধ্য হয়ে সায়েদাবাদ বাস কাউন্টারের উদ্দেশে রওনা দেন। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, বাসে চলাচল করতে অসুবিধা হয় তাই লঞ্চে চলাচল করি। ধর্মঘটের খবর আগে জানা ছিল না তাই বাধ্য হয়ে বাসেই যেতে হবে। অপর আরেক যাত্রী রেশমা বেগম। খুব সকালে দুই মেয়েসহ সদরঘাটে এসে দেখেন ঘাটে কোনো লঞ্চ নেই। দুই মেয়েকে নিয়ে ফিরে যান তিনি। তিনি বলেন, সকাল সকাল বিপদে পড়লাম। ভোরে ঘুম থেকে উঠে এসেছি লঞ্চ ধরার জন্য, এসে দেখি লঞ্চ নাই। লঞ্চ বন্ধ থাকায় বকুল ও রেশমার মতো অনেকে এদিন সকালে সদরঘাটে এসে নিরুপায় হয়ে ফিরে যান। নৌশ্রমিকদের ১০ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ ধর্মঘট চলবে বলে জানান নৌযান শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ ও শ্রমিক ফেডারেশনের নেতারা। নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আতিকুল ইসলাম বলেন, আমরা অনেক দিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছি কিন্তু তাতে কর্তৃপক্ষ কোনো কর্ণপাত করছে না। একের পর এক আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কোনো বাস্তবায়ন নেই। শ্রমিকদের দাবিগুলো না মানা হলে ধর্মঘট চলবে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট বদিউজ্জামাল বাদল বলেন, ‘নৌযান শ্রমিকরা ধর্মঘট করছে কিন্তু এখন আমাদের করার কিছু নেই। শ্রম মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হয়েছে। শ্রমিক-মালিক সমঝোতার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে। এদিকে নৌশ্রমিকদের ধর্মঘটে যাত্রী ভোগান্তি, পণ্য পরিবহন বন্ধ, বন্দরের কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, ব্রাক্ষণবাড়িয়া চাঁদপুর ও বাগেরহাটের মোংলা বন্দরে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো সংবাদে রয়েছে বিস্তারিত-

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম জানান, নৌশ্রমিকদের কর্মবিরতির কারণে ব্যাহত হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম। বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থানরত মাদার ভেসেল থেকে লাইটারেজ জাহাজে পণ্য খালাসে শ্রমিকরা যোগ না দেওয়ায় সংকট তৈরি হয়েছে। তবে বন্দরের অন্যান্য কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘শ্রমিক ধর্মঘটের কারণে বহির্নোঙরে পণ্য খালাস কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। তবে বন্দরের পণ্য ওঠা-নামাসহ অন্যান্য কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে।’

নৌযান শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ চট্টগ্রামের আহ্বায়ক শফিকুল ইসলাম বলেন, ১০ দফা দাবিতে আমাদের কর্মবিরতি চলছে। লাইটার জাহাজ, ট্যাংকার, যাত্রীবাহী লঞ্চ এ কর্মবিরতির আওতায় রয়েছে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের এ কর্মবিরতি অব্যাহত থাকবে।

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল জানান, ১০ দফা দাবিতে অনির্দিষ্ট কালের কর্মবিরতি শুরু করেছে নৌযান শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা। বন্ধ রয়েছে পণ্য পরিবহন। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কর্মবিরতি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন নৌযান শ্রমিকরা। তবে এ মুহূর্তে শ্রমিকদের দাবি মেনে নেওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন নৌযান মালিক সমিতির নেতারা।

বরিশাল বিভাগীয় নৌযান শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম জানান, নৌযান শ্রমিকদের এই দাবি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দিতে চাই। তিনি নৌযান শ্রমিকদের বিষয়টি বিবেচনা করবেন। শ্রমিকদের ন্যূনতম ২০ হাজার টাকা মজুরি প্রদানসহ ১০ দফা বাস্তাবায়ন করার কথা বলেন তিনি।

নিজস্ব প্রতিবেদক, খুলনা জানান, নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘটে খুলনা বন্দর। শনিবার মধ্য রাত থেকে নৌযোগাযোগ বন্ধ হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন খুলনার দাকোপ, পাইকগাছা, কয়রা, সাতক্ষীরাগামী যাত্রীরা। বন্ধ রয়েছে পণ্যবাহী লঞ্চও। এদিকে ধর্মঘটের সমর্থনে গতকাল খুলনার বিআইডব্লিউডি ঘাটে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন শ্রমিকরা। ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজার টাকা ও নৌযান শ্রমিকদের নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র, সার্ভিস বুক প্রদানসহ ১০ দফা দাবি আদায়ে এ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে।

খুলনা নৌযান শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ফারুখ হোসেন বলেন, বর্তমানে একজন শ্রমিক ৭ হাজার ৭৫০ টাকা মজুরি পায়। প্রতিদিন ২৩৩ টাকা তাদের মজুরি। বর্তমান বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে শ্রমিকরা সংসার চালাতে পারছেন না। তারা বারবার মালিকদের কাছে দাবি জানানো হলেও কর্ণপাত করছে না। বেতন বৃদ্ধি করছে না। সংগ্রাম-কর্মবিরতি করা ছাড়া আর কোনো গতি নেই। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কর্মবিরতি চলবে।

বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, নৌশ্রমিকদের ধর্মঘটের প্রভাবে গতকাল মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলের বিভিন্ন এলাকায় কয়েক শ লাইটার জাহাজ নোঙর করে রেখেছেন নৌযান শ্রমিকরা। এর ফলে বন্দরে খালাস করা কোনো পণ্য নৌপথে পরিবহন হয়নি। এদিকে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির প্রথম দিনে মোংলায় নৌযান শ্রমিকরা মিছিল সমাবেশ করেছেন।

বাংলাদেশ লাইটারেজ শ্রমিক ইউনিয়নের মোংলা শাখার সহসভাপতি মাইনুল হোসেন মিন্টু জানান, নৌযান শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিসহ ১০ দফা দাবিতে আদায়ের লক্ষ্যে ১৯ নভেম্বর সারা দেশের নৌবন্দরগুলোতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ থেকে সরকার এবং মালিকপক্ষকে আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছিল। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি চলবে। কর্মবিরতির প্রথম দিনে রবিবার সকালে মোংলায় মজুরি বৃদ্ধিসহ ১০ দফা দাবি আদায়ে নৌযান শ্রমিকদের পক্ষ থেকে মিছিল সমাবেশ করা করেছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি জানান, মজুরি বৃদ্ধিসহ ১০ দফা দাবিতে শ্রমিক ফেডারেশনের ডাকা সারা দেশের ন্যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জেও অনির্দিষ্টকালের নৌযান ধর্মঘট শুরু হয়েছে। শনিবার রাত থেকে আশুগঞ্জ বন্দরে প্রায় অর্ধশত পণ্যবাহী জাহাজ নোঙর করে রেখেছে। এসব জাহাজ থেকে পণ্য ওঠানামা বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া আশুগঞ্জ থেকে কোনো প্রকার নৌযান ছেড়ে যাচ্ছে না। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।

নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কোষাধ্যক্ষ হাবীল্লাহ বাহার মাস্টার জানিয়েছেন, রাত ১২টা থেকে লাগাতার কর্মবিরতি পালন শুরু করেছেন সারা বাংলাদেশের নৌযান শ্রমিকরা। আশুগঞ্জ বন্দরের শ্রমিকরাও এই কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে সব ধরনের নৌযান পরিচালনা থেকে বিরত রয়েছে।

চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, চাঁদপুরেও বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশনের উদ্যোগে ১০ দফা দাবিতে অনির্দিষ্ট ধর্মঘটে ভোগান্তিতে পড়ছেন যাত্রীরা। ঢাকার উদ্দেশে বের হওয়া যাত্রী আলমগীর ও শফিকুল ইসলাম জানান, হঠাৎ করে লঞ্চ ধর্মঘট ডেকেছে, যা ঘাটে এসে জানতে পেরেছি। এখন কোনো লঞ্চ চলাচল না করায় পরিবার পরিজন নিয়ে ভীষণ বিপাকে পড়েছি। আবার বাড়ি ফিরে যেতে হবে। তাই পরিবারকে বাড়িতে রেখে একাই বাসে ঢাকায় যাব।

সর্বশেষ খবর