মঙ্গলবার, ১৪ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

সেই যুদ্ধটা কখনই ‘পাক-ভারত’ বা ‘তেরো দিনের’ যুদ্ধ ছিল না

জাফর ইমাম বীরবিক্রম

সেই যুদ্ধটা কখনই ‘পাক-ভারত’ বা ‘তেরো দিনের’ যুদ্ধ ছিল না

৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেরও বেশি পেরিয়ে গেছে। দুনিয়া কাঁপানো এ যুদ্ধকে অনেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে ‘পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ’ কিংবা ‘তেরো দিনের যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেন। একশ্রেণির জ্ঞানপাপী লেখক, বুদ্ধিজীবী বা উপস্থাপক দেশে-বিদেশে সংঘবদ্ধ এমন একটি দুষ্টচক্র, যারা আমাদের ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মাহুতি এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার এই গৌরবময় অর্জনকে বিকৃত করছে। অথচ ইতিহাসের প্রতি এই ধরনের অনাচার, ইতিহাস বিকৃত করার ধৃষ্টতা, সর্বোপরি নবীন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুপরিকল্পিতভাবে বিভ্রান্ত করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। তারা এই গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধকে শুধু খাটোই করছে না, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের রূপকার এবং নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ও বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণের অসীম ত্যাগকে উপেক্ষা ও উপহাস করছে। যুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি জাতিসংঘের যুদ্ধ ইতিহাস বিকৃত করা সম্পর্কিত ঘোষণা মতে, এটি একটি ক্ষমাহীন যুদ্ধাপরাধ। দেশে-বিদেশে এ ধরনের যুদ্ধ ইতিহাস বিকৃতকারীদের চিহ্নিত করে এই ঘোষণা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। পাশাপাশি বিলম্বে হলেও আমাদের ৯ মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট, অপূরণীয় আত্মাহুতি এবং গৌরবময় অর্জনের সঠিক ইতিহাস বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করা স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের দায়বদ্ধতা রয়েছে, যেন আমাদের প্রজন্ম যুগ যুগ ধরে আমাদের জাতিসত্তার ঐতিহ্যকে ধারণ, লালন ও পালন করতে পারে। আমাদের ৯ মাসের মহান স্বাধীনতার যুদ্ধ হঠাৎ করে বা রাতারাতি সংঘটিত হয়নি, এমনকি এই স্বাধীনতা যুদ্ধ ইতিহাসের কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনাও নয়। বাংলাদেশের ৯ মাসের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকারী এই তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও লেখক চক্রের গভীর ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল থেকে আমাদেরকে আমাদের গৌরবময় ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএএস) এবং পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিলপ্রণেতা লে. জেনারেল জ্যাকব মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের বীরোচিত যুদ্ধযজ্ঞ এবং সাহসিকতা প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি সব সময় বলেছি, এটি ছিল আপনাদের (বাঙালিদের) মুক্তিযুদ্ধ। এটি ছিল আপনাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং এতদভিন্ন আর কিছুই নয়। আমি বলতে চাই, মুক্তিযোদ্ধা এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক ও অফিসাররা তাদের সীমাবদ্ধ সম্পদ-সরঞ্জাম নিয়েও একটি শক্তিশালী নিয়মিত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছেন এবং তাদের দেশপ্রেম এ যুদ্ধে তাদেরকে জয়ী করেছে। আমরা তাদেরকে সহায়তা দিয়েছি, আমরা ছিলাম তাদের সহযোদ্ধা। কিন্তু এ যুদ্ধ ছিল তাদের যুদ্ধ, তারা এ যুদ্ধে লড়েছেন। তারা দেশপ্রেমের সঙ্গে লড়েছেন এবং জয়ী হয়েছেন। তাদের প্রতি আমার আন্তরিক অভিনন্দন ও আশীর্বাদ রইল। এই সাহসী মুক্তিযোদ্ধারা আপনাদের এমন এক শক্তি, যাদেরকে নিয়ে গোটা দেশ গর্ব করতে পারে।’ অথচ মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর অতিবাহিত হলেও আমরা আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে স্বাধীনতার সঠিক প্রেক্ষাপট এবং সত্যিকারের ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন করে তোলার মতো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিতে পারিনি। আমাদের এ যুদ্ধের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, যুদ্ধের প্রস্তুতি ও পদার্পণ, সংগঠিতকরণ, সর্বোপরি আমাদের এ যুদ্ধ গণযুদ্ধে রূপান্তর ও ৯ মাসের যুদ্ধের ধারাবাহিক ইতিহাস সঠিকভাবে লিখন, গবেষণা, প্রকাশনা, সংরক্ষণ (আর্কাইভ), জাতীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ও ধারাবাহিকতার যথার্থ এবং পূর্ণাঙ্গ ডকুমেন্টেশন প্রভৃতির অনেক ঘাটতি রয়েছে। তাই আমি বলব, রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে জাতীয় পর্যায়ে সংশ্লিষ্টদেরকে এক করে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে গবেষণা, পূর্ণাঙ্গ ডকুমেন্টেশন বিলম্বে হলেও প্রচার ও প্রকাশ করতে হবে, যেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম এ ইতিহাসের ঐতিহ্যকে ধারণ লালন ও পালন করতে পারে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করতে পারে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাহান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ছাত্র আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ’৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন সমগ্র পাকিস্তানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন। অথচ আমাদের ওপর পাকিস্তানিদের বৈষম্য ও নির্যাতনের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে তারা বাঙালি জাতিসত্তাকে চিরতরে নির্মূল করার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের মার্চে ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে কালক্ষেপণ করতঃ একটি যুদ্ধ প্রস্তুতি নিতে থাকে।

বঙ্গবন্ধুও জানতেন তারা কখনই ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তাই তিনিও আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে গোটা জাতিকে একটি যুদ্ধের জন্য ধীরে ধীরে প্রস্তুত করছিলেন, যার প্রতিফলন তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ। এই ভাষণই ছিল স্বাধীনতার প্রকৃত ঘোষণা এবং যুদ্ধ প্রস্তুতির আহ্বান। তিনি শত্রু পক্ষকে মোকাবিলার জন্য গেরিলা এবং সম্মুখ সমর উভয় যুদ্ধের ইঙ্গিতবহ ঘোষণা প্রদান করেন তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে (‘আমরা তোমাদের ভাতে মারব, পানিতে মারব’)। জাতির উদ্দেশে তিনি যুদ্ধ প্রস্তুতির লক্ষ্যে ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার’ নির্দেশ দিয়ে বলেন- ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’। এর পাশাপাশি দেশব্যাপী সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ইঙ্গিতও ছিল তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে (‘অফিস আদালত বন্ধ থাকবে। কেউ কাজে যোগ দেবে না। ১ তারিখে গিয়ে বেতন নিয়ে আসবা’)। সেদিন গণবিচ্ছিন্ন বিশেষ একটি অংশ ব্যতিরেকে ডান-মধ্য-বাম দলমত নির্বিশেষে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মওলানা ভাসানীসহ জাতীয় নেতৃত্ব মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। বিচক্ষণ ও দূরদর্শী বঙ্গবন্ধুর ধারণা সঠিক ছিল এবং তাঁর স্বাধীনতা অর্জনের স্বপ্নের সেই প্রতীক্ষিত ক্ষণগণনা শুরু হয় যখন ২৫ মার্চেও মধ্যরাতে পাকিস্তানিরা তথাকথিত ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ নামে ব্যাপক গণহত্যার পাশাপাশি সমগ্র বাংলাদেশে নৃশংস ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠে। সারা দেশে রক্তের বন্যা বয়ে যায় এবং সংঘটিত হয় ইতিহাসের নিকৃষ্টতম গণহত্যাযজ্ঞ। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে ধ্বংসের আগুন।

বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয় তাঁর বাসভবন থেকে। তিনি পালিয়ে যাননি। যদি তিনি পালিয়ে ভারতে বা অন্য কোথাও আত্মগোপনে চলে যেতেন তাহলে তাঁকে গোটা পৃথিবী ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত করত এবং আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ বিশ্বের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হতো। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগারে বন্দি থাকলেও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তাঁর নামের ওপরই চলছিল। তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলার প্রবাসী সরকারের রাষ্ট্রপতি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধুকে যদি সেদিন প্রবাসী সরকারের রাষ্ট্রপতি দেখানো না হতো, সেক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সহযোগিতায় ঘাটতি দেখা দিত ও বিশ্ব জনমতেও ফাটল দেখা দিত এবং বঙ্গবন্ধুর ডাকে সংঘবদ্ধ জনগণের মধ্যেও সেদিন স্বাধীনতার জন্য যে আশা, উদ্দীপনা দেখা দিয়েছিল, তাতেও ঘাটতি পরিলক্ষিত হতো। রণাঙ্গনের প্রতিটি বাঙ্কারে বাঙ্কারে সেদিন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান বা রণধ্বনিতে বঙ্গবন্ধু ছিলেন সজীব, প্রাণবন্ত উদ্দীপনা এবং রণাঙ্গনে স্বাধীনতার চেতনার প্রতীক ও প্রতিচ্ছবি। এটিই ছিল ৯ মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধের বাস্তবতা। ’৭১ এর ৯ মাসব্যাপী এ যুদ্ধ ছিল আমাদের শ্রেষ্ঠতম জাতীয় ঐতিহ্য, ঐতিহাসিক অর্জন এবং স্বাধীন জাতিসত্তা বিকাশের প্রধান অনুপ্রেরণা। কাজেই এ যুদ্ধ কখনই ‘পাক-ভারত যুদ্ধ’ কিংবা ‘তেরো দিনের যুদ্ধ’ ছিল না। সেই ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ধামাচাপা দেওয়ার এই সুগভীর ষড়যন্ত্র জ্ঞানপাপীরা এখনো অব্যাহত রেখেছে। তাই বিলম্বে হলেও আজ সময় এসেছে এদের ষড়যন্ত্র থেকে আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসকে রক্ষা করা।

২৫ মার্চ থেকে সমগ্র বাঙালি জাতি তথা ছাত্র-যুবক-কৃষক-শ্রমিক- সেনা-নৌ-বিমান বাহিনীর সদস্য, পুলিশ, ইপিআর, আনসার, মুজাহিদসহ সর্বস্তরের মুক্তিকামী জনগণ সংঘবদ্ধ হয়ে গ্রামপর্যায়ে গেরিলা যুদ্ধ এবং ১১ সেক্টরে বিভক্ত হয়ে নিয়মিত বাহিনী এবং পরবর্তীতে যুদ্ধে ‘কে’, ‘এস’ এবং ‘জেড’ ফোর্স গঠন, নৌবাহিনীর ‘জ্যাকপট অপারেশন’, বিমান বাহিনীর ‘কিলো ফ্লাইট অপারেশন’ প্রভৃতির মাধ্যমে প্রবাসী অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের তত্ত্বাবধানে এবং জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় ৯ মাসের এক সর্বাত্মক গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধ পরিচালিত হয়। যুদ্ধের শুরু থেকেই ভারতের জনগণ ও সরকার, ‘বিএসএফ’ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর সর্বাত্মক সহযোগিতায় জুন-জুলাই পর্যন্ত আমাদের প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার প্রশিক্ষিত বিভিন্ন বাহিনীর সশস্ত্র সদস্য ছাড়াও সেক্টরভিত্তিক ব্যাপক সংখ্যক গেরিলা যোদ্ধা গেরিলা এবং সম্মুখ যুদ্ধ যুগপৎ অব্যাহত রাখেন। এই পর্যায়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী বিভিন্ন রণাঙ্গনে আমাদেরকে আর্টিলারি-সহায়তা প্রদান করে এবং আমাদের সেক্টরভিত্তিক নিজস্ব প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ভারতীয় বাহিনী প্রশিক্ষণ সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখে। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা রাজ্যে সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণ মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদের প্রায় ১ কোটি শরণার্থীর খাদ্য ও আশ্রয় প্রদান অব্যাহত রাখেন।

লেখকের সাম্প্রতিক বই LIBERATION WAR ’৭১-এর সারসংক্ষেপের একাংশ।

লেখক : মুক্তিযুদ্ধের সাব-সেক্টর কমান্ডার ও দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা-অধিনায়ক।

সংশোধনী : গতকাল এই কলামে প্রকাশিত মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীরউত্তমের লেখার শেষ প্যারায় চট্টগ্রামের ‘কুমিল্লা’ ছাপা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হবে ‘কুমিরা’।

সর্বশেষ খবর