উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণে সংসদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। ফলে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া আপিল বিভাগের রায় বহাল রইল। একই সঙ্গে বিচারকদের অপসারণে সংবিধানে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সংক্রান্ত বিধান পুনর্বহালও করা হয়েছে আদেশে। গতকাল প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ আদেশ দেন। ২০১৪ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, রিটকারীর পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ শুনানি করেন। আদালতের অনুমতি নিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল।
আদেশের পর নিজের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, এ রায়ের ফলে কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে অসমর্থতা ও পেশাগত অসদাচরণের অভিযোগ উঠলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। এসব বিষয়ে সব ধরনের অস্পষ্টতা দূর হয়েছে। তিনি বলেন, অনেক আগেই ষোড়শ সংশোধনী মামলার রিভিউ আবেদন ফাইল করা ছিল। সেখানে ৯৪টি গ্রাউন্ড ছিল। আমরা সব গ্রাউন্ডই পড়েছি। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, এ গ্রাউন্ডগুলোর একটিও গুড গ্রাউন্ড না। আমরা আদালতকে বলেছি, ওই গ্রাউন্ডগুলো প্লেস করব না। আমরা আদালতে বলেছি, বিচারপতিদের পদত্যাগ করার বিধান নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। সেই বিষয়টি আদালতের সামনে তুলে ধরেছি। তিনি বলেন, আদালত আমাদের বক্তব্য শুনেছেন। আদালত মনে করেছেন, যে কোনো অস্পষ্টতা দূর করা প্রয়োজন। এ কারণে ৯৬ অনুচ্ছেদে ২ থেকে ৮ পর্যন্ত পুরোপুরি পুনর্বহাল করা হয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এ আদেশের ফলে একদিকে বিচার বিভাগ দুর্বৃত্তায়ন রাজনীতির খপ্পর থেকে বেরিয়ে এলো। বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের পথ পেল। রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, এই আদেশের ফলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল রইল এবং বিচারপতি পদত্যাগ করলে সেটি এখন থেকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের নিয়মের মধ্যে পড়বে। আদেশের পর আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস সাংবাদিকদের বলেন, সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ২ থেকে ৮ পর্যন্ত বিধান ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল করা হয়েছিল। এগুলো পুনর্বহাল করেছেন আপিল বিভাগ। এই রায়কে ঐতিহাসিক বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল। তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অপসারণের পথ উন্মুক্ত হলো। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার রিভিউ শুনানির উদ্যোগ না নেওয়ায় দুর্নীতি ও অসদাচরণের অভিযোগ ওঠার পরও হাই কোর্টের তিন বিচারপতির বিরুদ্ধে তদন্ত ঝুলে রয়েছে পাঁচ বছর ধরে। এখন রিভিউ নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়ায় ওই তিন বিচারপতিসহ মোট ১৫ বিচারপতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার পথ উন্মুক্ত হবে। ১৯৭২ সালে প্রণীত মূল সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে ছিল। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে অর্পণ করা হয়। পরে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে। মার্শাল প্রক্লেমেশনে করা পঞ্চম সংশোধনীতে এক্ষেত্রে ৯৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন আনা হয়েছিল। এরপর সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পর্যন্ত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলই বহাল ছিল। পরে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিল আনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ওই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর সংসদে এ সংক্রান্ত বিল পাস হয়। একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। সংবিধানের এ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয় আইনজীবী হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন। এ রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে একই বছরের ৯ নভেম্বর এ সংশোধনী কেন অবৈধ, বাতিল ও সংবিধান পরিপন্থি ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাই কোর্ট। রুল শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ৫ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্টের বিশেষ বেঞ্চ। রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পাওয়ার পর ২০১৭ সালের ৪ জানুয়ারি এ বিষয়ে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। ওই আপিলের শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ৩ জুলাই হাই কোর্টের রায় বহাল রেখে সর্বসম্মতিক্রমে চূড়ান্ত রায়টি দেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ। পরে একই বছরের ১ আগস্ট ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশিত হয়। এ রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে। গতকাল সেই রিভিউ আবেদন পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করে আদেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। এর আগে বেশ কয়েকবার সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া আপিল বিভাগের রায় রিভিউ চেয়ে করা আবেদন কার্যতালিকায় এলেও শুনানি হয়নি।
রায় নিয়ে সরকারদলীয়দের ক্ষোভ ও বিচারপতি এস কে সিনহার দেশত্যাগ : ষোড়শ সংশোধনী মামলায় আপিল বিভাগের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পরই তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায় তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। বিচারপতি সিনহা তার লেখা রায়ে গণতন্ত্র, রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, সুশাসন, দুর্নীতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দেন। রায়ে তার বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগের সরকারের মন্ত্রী, দলীয় নেতা ও দলটির সমর্থক আইনজীবীরা। তারা প্রধান বিচারপতি সিনহার পদত্যাগের দাবি তোলেন। একপর্যায়ে বিচারপতি এস কে সিনহা ছুটি নিয়ে বিদেশে চলে যান। তাকে অসুস্থতার কথা বলে ছুটিতে যেতে বাধ্য করা হয়েছে বলেও তখন আলোচনা ছিল। যদিও ২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবর বিদেশে যাওয়ার প্রাক্কালে তিনি গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, তিনি অসুস্থ নন, ক্ষমতাসীনদের সমালোচনায় তিনি বিব্রত। ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি অবসরে যাওয়ার কথা ছিল বিচারপতি সিনহার। কিন্তু নজিরবিহীন এক পরিস্থিতির মধ্যে তার কার্যকাল শেষ হয় মেয়াদের ৮১ দিন আগেই। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের তোপের মুখে ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর ২০১৭ সালের ১১ নভেম্বর তিনি সেখানে থেকেই পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন।
৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের আগ পর্যন্ত এস কে সিনহার দেশত্যাগ ও প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগের বিষয়ে তেমন কিছু জানা যায়নি। তবে গত ১৪ আগস্ট একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিচারপতি এস কে সিনহা দাবি করেন, একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করে তাকে দেশত্যাগ ও পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। সাক্ষাৎকারে সাবেক এই প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বাংলাদেশে আমার শেষ দিনগুলো খুবই ভয়ংকর ছিল, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কারণ, এটি উপলব্ধির প্রশ্ন। একজন বর্তমান প্রধান বিচারপতি হিসেবে আমাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল। আমাকে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি। আমার ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল, আমার বাড়িতে গোয়েন্দারা স্ট্যান্ড গার্ড হিসেবে ছিল। তারা আমার বাড়িতে ঢোকার সময় আমার এক কর্মীকে মারধর করে।’
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কাজ করে যেভাবে : ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রিভিউ নিষ্পত্তির পর এই কাউন্সিলের কার্যক্রমের বিষয়টি খোলাসা করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। নিজ কার্যালয়ে গণমাধ্যমকে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে কোনো অভিযোগ করলে বা পেলে তারা প্রাথমিকভাবে সেটি অনুসন্ধান করবেন। যাচাইবাছাই করে দেখবেন যে, অসদাচরণ বা দুর্নীতি (অর্থনৈতিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক) পাওয়া গেছে কি না। তাহলে রিপোর্টটা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। রাষ্ট্রপতি বিচার-বিবেচনা করে তারপর আবার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে পাঠাবেন। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল তখন ফুল তদন্ত করবেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপতির। তবে এখানে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত মেকানিক্যাল। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের দায়িত্ব হলো অসদাচরণ প্রমাণিত হয়েছে কি না, এটাসহ সুপারিশ পাঠানোর। অ্যাটর্নি জেনারেল জানান, এ পর্যন্ত একজন বিচারপতিকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে অপসারণ করা হয়। সেটা ২০০৪ সালের ২০ এপ্রিল হয়েছিল।