ঐতিহাসিক জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আমরা নির্বাচনের কথা বলেছি। যে সুর আজকে বাজালাম, সেই সুর নিয়ে আমরা নির্বাচনে যাব। ঐক্যের সুর নিয়ে সবাই নির্বাচনের দিকে যাব। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে এবং এই ঐক্য যেন বজায় থাকে। আজকে ঐকমত্যে আমরা যেমন সনদ করলাম, নির্বাচনের ব্যাপারেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বসে একটা সনদ করেন, কীভাবে নির্বাচন করবেন। যেমন-তেমন করে নির্বাচন করলে তো আবার পুরোনো জায়গায় ফিরে যাওয়া। তাহলে এত কিছু করে লাভ কী হলো! এ কথা লিখে লাভ কী হলো? কথা লিখলাম, কথা মানলাম না। কাজের মধ্য দিয়ে মানলাম না।
গতকাল রাজধানীর শেরেবাংলানগর সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ‘জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর’ অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি জুলাই সনদ স্বাক্ষরের বিষয়টিকে ‘ঐতিহাসিক’ উল্লেখ করে ‘বর্বরতা থেকে সভ্যতায় আসার প্রমাণ’ বলে মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, এখন কাজে প্রমাণ করতে হবে যে, আমরা সেই সভ্যতা অর্জন করেছি। রাজনীতিবিদদের বসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, নিজেরা বসুন, নির্বাচনটা কীভাবে সুন্দরভাবে করবেন, উৎসবমুখরভাবে করবেন, ইতিহাসে স্মরণীয় করে রাখবেন। আমরা কি জানি না, কীভাবে নির্বাচন সুন্দরভাবে করতে হয়? সেটা যেন একটা উদাহরণ হয়। সেটা জাতির জন্য উদাহরণ। বিশ্বের জন্য উদাহরণ হবে এমন নির্বাচন আমরা করতে চাই। আমরা ইনশা আল্লাহ পারব। আজকে সেই চিহ্ন আমরা এখানে রেখে গেলাম। এই চিহ্ন ধরে আমরা অগ্রসর হব।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ঐকমত্যের মাধ্যমে যে কঠিন কঠিন কাজ সমাধান করা যায়, আমরা যে বর্বরতা থেকে সভ্যতায় এসেছি তার প্রমাণ রাখা যায়। এখন তো কাগজে আমরা প্রমাণ করলাম, সেই সভ্যতা আমরা নিয়ে আসলাম। এখন কাজে প্রমাণ করতে হবে যে, আমরা সেই সভ্যতা অর্জন করেছি। রাজনৈতিক নেতারা আমাদের সে পথ দেখিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, এমনভাবে নির্বাচন করব, দুনিয়ার কেউ এসে বলতে পারবে না, এখানে খুঁত আছে, ওখানে গোলমাল হয়েছে। বাইরের লোক এসে কেন আমাদের বলবে তোমরা এটা ঠিক করোনি, ওটা ঠিক করোনি। আমরা কী জাতি হলাম, যে বাইরের কথার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
ঐকমত্য কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলো অসম্ভবকে সম্ভব করেছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তারা ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে থাকবেন। তাদের নাম অক্ষয় হয়ে থাকবে। লোকে চিন্তা করবে তারা কীভাবে এটা করেছিল। আজকের এই দিনটি মহান দিন উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এটার কথা চিন্তা করলে গা শিহরে ওঠে, এমন একটি দিন। সেটা শুধু জাতির জন্য না, সারা পৃথিবীর জন্য একটা বড় রকমের উদাহরণ হয়ে থাকবে। বহু জায়গায় সেটা পাঠ্যপুস্তকে থাকবে। ক্লাস রুমে আলোচনা হবে। রাজনীতিবিদদের মধ্যে এটা নিয়ে আলোচনা হবে বিভিন্ন দেশে কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক, তারা কী বলল, আমরা কী চাই। তারা চেষ্টা করে দেখবে তাদের দেশে সেটা সম্ভব কি না? যে উদাহরণ আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা সৃষ্টি করেছেন, সেটা দেশের জন্য তো বটেই, সারা পৃথিবীর জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে। গণ অভ্যুত্থানের নায়কদের কথা স্মরণ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, তাদের কাছে জাতি চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। আমরা পুরোনো কথাবার্তা সব পাল্টে ফেলে নতুন কথাগুলো আমাদের জাতীয় জীবনে নিয়ে আসলাম। আমাদের সংবিধানের পরিবর্তনের মধ্যে নিয়ে আসলাম। সরকার চালানোর ভিতরে নিয়ে আসলাম। অনেক বিষয় এসেছে, এ পরিবর্তনের ভিতরে। এ পরিবর্তন এখন আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমরা সেই পথে অগ্রসর হব। আজকে আমাদের নবজন্ম হলো। এ স্বাক্ষরের মাধ্যমে আমরা নতুন বাংলাদেশের সূচনা করলাম।
এই দেশ তরুণদের, তারাই পথ দেখাবে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এখানে ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে অর্ধেকই ২৭ বছরের নিচে। এটাই আমাদের সম্পদ। সারা দুনিয়া অবাক বিস্ময়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, কখন আমরা তাদের সাহায্য করব এই তরুণদের পাঠিয়ে। কারণ সারা দুনিয়াতে তরুণদের অভাব। কোনো কোনো দেশে তরুণ নেই বলতে গেলে! কাজেই তারা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি আরও বলেন, শুধু বাংলাদেশ না, পৃথিবীকে পরিবর্তন করার সুযোগ তাদের কাছে এসেছে। আমাদের কাছে দরখাস্ত আসছে, এত জনবল পাঠান। যত পারেন পাঠান। এটা তো ২০২৫ সালের কথা, ২০২৬ সালে কী বলবে? ২০২৭ সালে কী বলবে? হাত জোড় করে করে আসবে। কারণ আমাদের তরুণরা ছাড়া পৃথিবীতে এত তরুণ দিতে পারে, এত তাজা শক্তি দিতে পারে, এত সৃজনশীল মানুষ দিতে পারে, এত বিশ্বস্ত মানুষ দিতে পারে দেশ খুঁজে পাওয়া যাবে না। কাজেই সেই দেশকে গঠন করার দায়িত্ব আগামী সরকারকে নিতে হবে। সেটার জন্য প্রস্তুতি হচ্ছে আমাদের সনদ। এই সনদের মাধ্যমে আমরা আরেকটি বড় কাজ করলাম, বর্বরতা থেকে সভ্যতায় আসলাম। আমরা এক বর্বর জগতে ছিলাম, যেখানে আইনকানুন ছিল না। মানুষ যা ইচ্ছা তা করতে পারত। এখন আমরা সভ্যতায় আসলাম এবং এমন সভ্যতা আমরা গড়ে তুলব মানুষ ঈর্ষার চোখে আমাদের দেখবে। কাজেই সেটা সনদ পরবর্তী জীবন আমরা কীভাবে গঠন করব তার ওপর নির্ভর করবে। ঐকমত্যে পৌঁছাতে কী কী বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে তা তরুণদের জানাতে পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হবে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তারা যেন দেখে তাদের নেতারা তাদের বিষয়গুলো কীভাবে বিবেচনা করছেন। কীভাবে ?সিদ্ধান্তে আসছেন। তারা যেন অনুপ্রাণিত হয়। আজকে শুধু অনুষ্ঠান না, সারা জাতি এটা থেকে অনুপ্রাণিত হবে। নতুন পথের দিশা পাবে। আমরা ছোট জাতি না, কারও দয়াদাক্ষিণ্যে বেঁচে থাকার জাতি না, আমরা কারও কথার তলে থাকি না, আমরা আমাদের মতো চলি, মাথা উঁচু করে চলি এবং সারা দুনিয়াতে আমরা মাথা উঁচু করে চলব। সেই সামর্থ্য আমাদের আছে। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আমরা অন্য দেশকে দেব। আমাদের সেই সামর্থ্য আছে। অন্য দেশ আমাদের কাছে শিখবে। আজকে যে সনদ সই হলো, এটা বহু দেশ শিখতে আসবে। এটা আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলে রাখলাম। এই যে একটা উদাহরণ সৃষ্টি করলেন, এরকম আরও বহু উদাহরণ আমরা সৃষ্টি করতে পারি। সেই পথে আমরা যেন যাই। আমরা একটা মহান জাতি। এটা অনুভব করতে হবে। কেউ যেন আমাদের ধাক্কা দিয়ে চলে যেতে না পারে। আমাদের দেখলে সম্মান করে। মাথা নিচু করে থাকে। এখনো তারা চিন্তা করে, এত কিছু কীভাবে করল! অভ্যুত্থান করল, এত বছরের সরকারকে ফেলে দিল, পালিয়ে গেল সরকার, একটা নতুন সরকার করল, একটা নতুন সনদ করল, এত কিছু করল তারা! এটাই অবাক বিস্ময়ে তাকাচ্ছে।