প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার শেষ মেয়াদের শেষ ভাষণে আমেরিকানদের এবং অনাগত ভবিষ্যতে উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা বললেন। চলমান সমস্যার সমাধানে জাতিগত ঐক্য এবং আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব অক্ষুণ্ন রাখতে আরও উদার হবার পরামর্শ দিলেন। টানা এক ঘণ্টার এ ভাষণে ওবামা হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে বললেন, ‘আমি সেই আমেরিকা চিনি, সেই দেশকে ভালোবাসি অত্যন্ত খোলাচিত্তে, হৃদয় উজার করে। যে কোন চ্যালেঞ্জকে দ্বিধাহীনভাবে মোকাবেলায় বিশ্বাসী, সম্ভাবনাকে আলিঙ্গনে পারদর্শীতাই আমেরিকানদের প্রকৃত সত্য। আমেরিকানদের এই দেশপ্রেম আর মহানুভবতায় কোন শর্ত নেই। আর এভাবেই আমাকে প্রচণ্ড আশাবাদী করে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ব্যাপারে। আর এটি ঘটে আপনাদের কারণে। কারণ আমি আপনাদের উপর আস্থাশীল। আর এভাবেই আমাদের পুরো জাতি আজ সবচেয়ে শক্তিশালী।
ওবামা বলেন, আমি অনেকবার বলেছি যে, অর্থনৈতিক বিষয়গুলো তলায় পড়েছে রাজনৈতিক দামাডোলে। আর এটিও অনেকে বলে থাকেন যে, এহেন পরিস্থির কারণে আমরা দুর্বল হলেও আমাদের শত্রুরা ক্রমান্বয়ে জোরদার হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এখনও গোটাবিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী একটি জাতি। আমি জোর দিয়ে বলতে চাই যে, আমাদের ধারেকাছেও কেউ নেই। এই অহংবোধকে অনন্তকাল জিইয়ে রাখতে সকলকে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে জাতীয় স্বার্থে।
ওবামা বন্দুক নিয়ন্ত্রণের আইন তৈরির মধ্য দিয়ে আমেরিকানদের নিরাপদ জীবন-যাপনের পথ সুগম করার আহ্বান জানান কংগ্রেসের প্রতি। ওবামা ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণের জন্যে কিছু পরামর্শ দেন। ভঙ্গুর ইমিগ্রেশন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে কংগ্রেসকে দরদি হবার আহ্বান জানালেন আবারো। এছাড়া মজুরির সমতা সুসংহত করার কথাও বললেন অকপটে। নারী-পুরুষে মজুরির বৈষম্য কাম্য নয় বলেও উল্লেখ করলেন। একইসাথে, সারা আমেরিকায় ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির ওপর আবারো গুরুত্বারোপ করলেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। এ ধরনের ব্যবস্থা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের শেষ মূহূর্ত পর্যন্ত সোচ্চার থাকার অঙ্গিকারও করলেন ওবামা। তবে, হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকে এটি আমার শেষ বছর বলে শুধু এই বছরের কথাই বলবো না, আমি ৫, ১০, ১৫ বছর পরের কথাও বলে যেতে চাই। আমি আমাদের ভবিষ্যতের পরিকল্পনার কথা বলতে চাই।
মার্কিন কংগ্রেসের উভয়কক্ষের সকল সদস্যের উপস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ওবামা টানা এক ঘণ্টার এই ‘স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন ভাষণ’ ১২ জানুয়ারি রাত ৯টা ১০ মিনিটে শুরু করেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং স্পিকার রায়ান পোল ছিলেন মঞ্চে। অতিথির আসনে শূন্য ছিল একটি চেয়ার। সেটি নির্বিচার গুলিতে নিহতদের স্মরণে খালি রাখা হয়। এর আগে এমনটি ঘটেনি কখনো। বন্দুক নিয়ন্ত্রণে যথাযথ আইন প্রনয়ণে কংগ্রেসের উদাসীনতার পরিপ্রেক্ষিতে কদিন আগে ওবামা নির্বাহী আদেশ জারি করেছেন। সে আলোকে কংগ্রেসের ওপর চাপ প্রয়োগের অভিপ্রায়ে চেয়ার খালি রাখার কৌশল গ্রহণ করা হয় বলে অনেকে মনে করছেন।
ওবামা তার ভাষণে চলমান পরিস্থিতির আলোকপাত করে বলেন, এক্সট্রা অর্ডিনারি পরিবর্তনের মধ্যে আমরা বাস করছি। জীবন-যাপনে পরিবর্তন ঘটছে। গোটাবিশ্বে ঘটছে এমন পরিবর্তন। চিকিৎসা-বিজ্ঞানের পাশাপাশি অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতেও পরিবর্তনের হাওয়া টের পাচ্ছি সকলে। পরিবর্তনের সাথে সঙ্গতি রেখে এগিয়ে চলার জন্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারী শিক্ষাকেও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সন্ত্রাসীরাও নানাভাবে জনজীবনকে সন্ত্রস্ত করে রেখেছে। ওদের মোকাবেলার জন্যেও প্রতিনিয়ত প্রস্তুতি থাকতে হচ্ছে।
ওবামা বলেন, আগে যা সত্য ছিল, এখনও তা বিরাজিত রয়েছে। জাতি হিসেবে আমাদের একতাবদ্ধতা এবং সংহতি অনেক পুরনো, যা আমেরিকাকে সারাবিশ্বে ঐতিহ্যমন্ডিত করে রেখেছে। সে কারণেই সাম্প্রতিক মন্দাকে আমরা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি দুর্বার গতিতে। আইনের শাসনের প্রতি আমাদের অঙ্গিকার, সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্যে প্রয়োজনীয় সবকিছুর ইদ্ভাবন ইত্যাদি আমাদের সাহস দিয়েছে। এসব বিষয় সামনে রেখেই আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে সামনের নির্বাচন নিয়ে। কে হবে আমাদের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট, কারা নেতৃত্ব দেবেন পরবর্তি কংগ্রেসের-এসব আন্তরিকতার সাথে ভাবতে হবে। প্রথমেই ভাবতে হবে, চলতি অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেই সকলকে এগিয়ে চলার সহায়তা দেয়া এবং নিরাপত্তা অটুট রাখার ব্যাপারগুলো। দ্বিতীয়ত: তথ্য-প্রযুক্তি কীভাবে আমাদের কল্যাণে ব্যবহার করা যাবে-সেটিও ভাবতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের স্বার্থে টেকনোলজিকে কীভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হবে সেটি মাথায় রাখতে হবে অকৃপণচিত্তে।
ওবামা বলেন, ওবামা তার শাসনামলে এক কোটি ৪০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান করেছেন শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এটি উল্লেখ করেন ভাষণে। গত ৬ বছরে কল-কারখানাতেই ৯ লাখ আমেরিকানের কর্মসংস্থান হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
দরিদ্র আমেরিকানদের জন্যে নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের সাফল্যের বিবরণও দেন ওবামা। দারিদ্র্য দূর করার জন্যে দীর্ঘ ফিরিস্তি উপস্থাপন করে তিনি বলেন, প্রাইভেট সেক্টর হচ্ছে মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের অন্যতম অবলম্বন। এজন্যে আমার প্রশাসন প্রাইভেট সেক্টরের প্রতি সবসময় যত্নবান রয়েছে। সকল সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের।
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের গতি-প্রকৃতি প্রসঙ্গে ওবামা বলেন, আগে ছিল আল কায়েদা। সে স্থলে এসেছে আইএসআইএল। এটিকে অনেকেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ মনে করছেন। ওরা প্রতিদিনই অসহায়-নারী -শিশু হত্যায় নতুন নতুন সেক্টর বেছে নিচ্ছে। বিভিন্ন দেশকে ওরা সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছে। একে রুখতে হবে সম্মিলিতভাবে। আমাদের সংকল্পবদ্ধ থাকতে হবে ওদেরকে ধ্বংসের জন্যে, ওদের শেকড় ওপরে ফেলার জন্যে।
অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সমস্যা প্রসঙ্গে ওবামা বলেন, যতদিন পর্যন্ত আমরা আমাদের রাজনীতিকে সঠিক ধারায় প্রবাহিত করতে সক্ষম না হবো, ততদিন পর্যন্ত প্রত্যাশিত শান্তি-সমৃদ্ধি সম্ভব হবে না।
বিডি-প্রতিদিন/ ১৩ জানুয়ারি, ২০১৬/ রশিদা