শুক্রবার, ১ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা
ঐতিহ্য

নওগাঁর কুসুম্বা মসজিদ

নওগাঁর কুসুম্বা মসজিদ

৪৫৮ বছরের ঐতিহ্য ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে নওগাঁর মান্দা উপজেলায় অবস্থিত ঐতিহাসিক কুসুম্বা মসজিদ। স্বচ্ছ সলিলা দিঘির পশ্চিম পাড়ে ধূসর বর্ণের এই কুসুম্বা মসজিদ, যা জেলার ইতিহাস ও মুসলিম ঐতিহ্যের উজ্জ্বল নিদর্শন। মসজিদসংলগ্ন উত্তর-দক্ষিণ দিকে রয়েছে ৭৭ বিঘা বিশিষ্ট একটি বিশাল দিঘি। গ্রামবাসী ও মুসল্লিদের খাবার পানি, গোসল ও অজুর প্রয়োজন মেটানোর জন্য এ দিঘিটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এর পাড়েই তৈরি করা হয়েছে কুসুম্বা মসজিদ। কুসুম্বা মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে ৫৮ ফুট লম্বা, চওড়া ৪২ ফুট। চারদিকের দেয়াল ৬ ফুট পুরু। মসজিদের সামনের দিকে রয়েছে তিনটি দরজা। দরজাগুলো খিলানযুক্ত মেহরাব আকৃতির। মসজিদের চার কোনায় রয়েছে চারটি মিনার। মিনারগুলো মসজিদের দেয়াল পর্যন্ত উঁচু ও আট কোনাকার। ছাদের ওপর রয়েছে ছয়টি গুম্বজ। ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে তিনটি গুম্বজ নষ্ট হয়েছিল। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ পরে মসজিদটি সংস্কার করে। মসজিদের ভিতরে রয়েছে দুটি পিলার। উত্তর দিকের মেহরাবের সামনে পাথরের পিলারের ওপর তৈরি করা হয়েছিল একটি দোতলা ঘর। এ ঘরটিকে বলা হতো জেনান গ্যালারি বা মহিলাদের নামাজের ঘর। এখানে মহিলারা নামাজ পড়তেন। মসজিদের ভিতরে পশ্চিমের দেয়ালে রয়েছে তিনটি চমৎকার মেহরাবের ওপর ঝুলন্ত শিকল, ফুল ও লতাপাতার কারুকার্য। মসজিদের সামনের ভাগে রয়েছে খোলা প্রাঙ্গণ ও পাথর বসানো সিঁড়ি, যা দিঘিতে গিয়ে নেমেছে।
মসজিদের উত্তর দিক ঘেঁষে উঠেছে এক বিশাল আকারের তেঁতুল গাছ। ওই গাছটি পাঁচ টাকার নোটে মুদ্রিত হয়েছে। প্রবেশপথের একটু দূরে বাক্স আকৃতির একখণ্ড কালো পাথর দেখা যায়। একে অনেকে শিশুর কবর বলে মনে করেন।
জানা যায়, জনৈক কৃষক হালচাষের সময় তার জমিতে পাথরটির সন্ধান পান। সম্ভবত তার প্রচেষ্টায় জমি থেকে তুলে এনে রাস্তার পাশে রাখা হয়েছে। এ পাথরের গায়ে তোগড়া হরফে আরবি লিপি রয়েছে। আল মালিকু মা হুমম মোকাররামা আবুল মোজাফফর হোসেন শাহ বিন সৈয়দ আশরাফ আল হোসেন। অর্থাৎ তিনি শাসক যিনি পরাক্রমশালী ও সম্মানের অধিকারী সৈয়দ আশরাফ আল হোসেনের ছেলে আবুল মোজাফফর হোসেন শাহ। এ থেকে বোঝা যায় প্রস্তুরখণ্ডটি হুসেন শাহের স্মৃতিবিজড়িত। ইতিহাসবিদদের মতে, কুসুম্বা মসজিদ মুসলিম স্থাপত্যকলার এক অনুপম নিদর্শন। সবরখান বা সোলায়মান নামে ধর্মান্তরিত এক মুসলিম মসজিদটি নির্মাণ করেন। মূল প্রবেশপথে শিলালিপি থেকে প্রমাণিত হয় এ মসজিদটি ৯৬৬ হিজরি বা ১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দে শেরশাহের বংশধর আফগান সুলতান প্রথম গিয়াস উদ্দিন বাহাদুরের শাসনামলে (১৫৫৪-১৫৬০) নির্মিত। সে হিসাবে মসজিদটির বর্তমান বয়স ৪৫৮ বছর। কেন্দ্রীয় মেহরাবের ওপরাংশ শেরশাহের শাসনামলে নির্মিত।
রাজশাহী জেলা পরিষদের ওভারশিয়ার সুরেন্দ্র মোহন চৌধুরী বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে কুসুম্বা গ্রামের প্রাচীন ধ্বংসস্তূপ থেকে একটি শিলালিপি আবিষ্কার করেন। শিলালিপিটি বর্তমানে রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘরে রয়েছে। এটি পাঠে জানা যায়, সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের আমলে তার মন্ত্রী বা প্রশাসনিক কর্মকর্তা রামণ দল ৯০৪ হিজরি বা ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন। নির্মাণকাজ শেষ কবে হয় তার সঠিক কোনো সাল বা তারিখ জানা যায়নি। বেশ কয়েকজন দর্শনার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিপুল সম্ভাবনা থাকার পরও প্রয়োজনীয় নজরদারির অভাবে এ ঐতিহাসিক কুসুম্বা মসজিদ আকর্ষণীয় স্পট হিসেবে গড়ে উঠছে না। প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেকে আসেন এ মসজিদ পরিদর্শনে। কুসুম্বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নওফেল আলী বলেন, কুসুম্বা মসজিদের খাদেম মফিজ উদ্দিনসহ পাঁচজন সব সময় নিয়োজিত রয়েছেন, যাতে দর্শনার্থীদের কোনো সমস্যা না হয়। মুসল্লিদের সুযোগ-সুবিধা, অজু-গোসলের জন্য লেক খনন করা হয়েছে। পর্যাপ্ত সুযোগ-সবিধা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। একটি পিকনিক স্পট ও থাকার জন্য রেস্ট হাউস করার পরিকল্পনা রয়েছে।

সর্বশেষ খবর