মঙ্গলবার, ১৮ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

নীরব সৌন্দর্য রাজধানীর ভাস্কর্যগুলো

মোস্তফা মতিহার

নীরব সৌন্দর্য রাজধানীর ভাস্কর্যগুলো

পাথর বা ধাতব পদার্থের মাধ্যমে উচ্চতা, দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের ত্রিমাত্রিক অবয়বে কোনো দৃশ্যমান শিল্পকে তুলে ধরাই হচ্ছে ভাস্কর্য। একজন ভাস্কর বা শিল্পী তার সৃজনশীলতায় শিল্পের সুষমায় ইতিহাস বা আদর্শকে ভাস্কর্যে উপস্থাপন করেন। ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক খ্যাতির জন্য নান্দনিক সংস্কৃতি, মূল্যবোধজনিত অনুভব, আদর্শিক শৈলী ভাস্কর্যের সুনিপুণ শিল্পকর্মে ফুটিয়ে তোলেন একজন শিল্পী। পাথরে ও ধাতব পদার্থে বিবৃত করেন জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অহংকারের গল্পগুলো। দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যের ভাস্কর্যগুলো গর্বের সঙ্গে দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছে মহান স্বাধীনতা, বাংলার হাজার বছরের বর্ণাঢ্য সংস্কৃতির। রাজধানীর ভাস্কর্যগুলো কালের সাক্ষী হয়ে প্রজন্মকে জানান দিচ্ছে এ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও কৃষ্টি-কালচারের কথা। তিলোত্তমা রাজধানী ঢাকার সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি জাতিসত্তার পরিচয় তুলে ধরতে রাজধানীর ভাস্কর্যগুলো প্রজন্মের কাছে যেন ইতিহাসের নীরব বয়ানদাতা।

অপরাজেয় বাংলা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে স্থাপিত এই ভাস্কর্যটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মরণে নিবেদিত একটি ভাস্কর্য। অপরাজেয় বাংলায় তিনজন মুক্তিযোদ্ধাকে চিত্রায়িত করেছেন মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ। ‘অপরাজেয় বাংলা’ নামকরণ করেছিলেন প্রয়াত মুক্তিযাদ্ধা ও সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী। ৬ ফুট বেদির ওপর নির্মিত এর উচ্চতা ১২ ফুট, প্রস্থ ৮ ফুট ও ব্যাস ৬ ফুট। ভাস্কর্যটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। ১৯৭৩ সালে ডাকসুর উদ্যোগে ভাস্কর্যটির নির্মাণ শুরু হয়। ১৯৭৫ সালের পর অনেক দিন অপরাজেয় বাংলার নির্মাণকাজ বন্ধ ছিল। ১৯৭৯ সালের ১৯ জানুয়ারি পূর্ণোদ্যমে অপরাজেয় বাংলার নির্মাণকাজ শুরু হয়। আর ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে অপরাজেয় বাংলার উদ্বোধন করা হয়।

স্বোপার্জিত স্বাধীনতা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির পশ্চিম পাশে ডাস-এর পেছনে অবস্থিত অনিন্দ্য সুন্দর ভাস্কর্য ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’। এটি একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদারের অত্যাচারের একটি খন্ডচিত্র। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর এটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ১৯৮৮ সালের ২৫ মার্চ এটির কাজ শেষে উদ্বোধন করা হয়। এটি নির্মাণ করেছেন অন্যতম কীর্তিমান ভাস্কর শামীম সিকদার। ভাস্কর্যটি মুক্তিকামী বাঙালিকে মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।

শাপলা চত্বর : রাজধানীর ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিলে অবস্থিত ‘শাপলা চত্বর’ ভাস্কর্যটি। বাংলাদেশের জাতীয় ফুল শাপলার এই ভাস্কর্যটি নগরীর শোভাবর্ধনের পাশাপাশি রাজধানীকে তিলোত্তমা করার ক্ষেত্রে অনবদ্য ভূমিকা রাখছে। 

দোয়েল চত্বর : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কার্জন হলের সামনে অবস্থিত জাতীয় পাখি দোয়েলের আদলে তৈরি ভাস্কর্যটির নাম ‘দোয়েল চত্বর’। এর স্থপতি আজিজুল জলিল পাশা। এটি বাংলাদেশের জাতীয় বৈশিষ্ট্যের ধারক ও বাহক।

স্বাধীনতা সংগ্রাম : ‘স্বাধীনতা ভাস্কর্য’ এ দেশের সবচেয়ে বড় ভাস্কর্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডের সলিমুল্লাহ হল, জগন্নাথ হল ও বুয়েট সংলগ্ন সড়কদ্বীপে ১৯৯৯ সালে এটি নির্মাণ করেছেন ভাস্কর শামীম সিকদার। তিনি ১৯৮৮ সালে ফুলার রোডে অবস্থিত সেকেলে বাংলো স্টাইলের বাড়ির (বর্তমানে প্রো-ভিসির ভবন) সামনে পরিত্যক্ত জায়গায় ‘অমর একুশে’ নামে একটি বিশাল ভাস্কর্য নির্মাণ শুরু করেন। ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক ঘরোয়া পরিবেশে প্রয়াত অধ্যাপক আহমদ শরীফ এটি উদ্বোধন করেন। ১৯৯৮ সালে ওই স্থানে উদয়ন স্কুলের নতুন ভবন নির্মাণ শুরু হলে ভাস্কর্যটি স্থানান্তরের প্রয়োজন হয়। ভাস্কর্যটি সড়কদ্বীপে এনে রাখা হয়। পরে ভাস্কর ওই ভাস্কর্যটির অবয়ব পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ নাম দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের আলোকে নতুনভাবে নির্মাণ করেন। ১৯৯৯ সালের ৭ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটি উদ্বোধন করেন।

রাজু ভাস্কর্য : ঢাবি টিএসসির চত্বরে অবস্থিত ‘রাজু ভাস্কর্য’। ১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর জোট গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের সন্ত্রাসবিরোধী মিছিলে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত মিছিলের নেতৃত্বদানকারী ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা মঈন হোসেন রাজু ও তার সহযোদ্ধাদের স্মরণে এই ভাস্কর্যটি নির্মিত হয়। এটি নির্মাণ করেছেন ভাস্কর শ্যামল চৌধুরী।

‘স্মৃতি চিরন্তন’ : ফুলার রোডের সড়কদ্বীপে অবস্থিত ‘স্মৃতি চিরন্তন’ ভাস্কর্যটির ফলকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৪ জন শহীদের নাম রয়েছে। স্থাপনাটির প্রাথমিক নকশা করেছেন স্থপতি আবদুল মোহায়মেন ও মশিউদ্দিন শাকের।

‘গণহত্যা ফলক’ : জগন্নাথ হলের সামনে স্থাপিত ভাস্কর্যটির নাম ‘গণহত্যা ফলক’। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এই হলে গণহত্যার শিকার হন চারজন শিক্ষক, ৩৬ জন ছাত্র এবং ২১ জন কর্মচারী ও অতিথি। তাদের স্মরণেই এই ‘গণহত্যা ফলক’ ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়েছে।

মধুসূদন দে স্মৃতি ভাস্কর্য : বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন ও সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু মধুর ক্যান্টিন। তার পুরোনাম মধুসূদন দে। তবে মধুদা নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। তার নামানুসারে এই ক্যান্টিনটির নামকরণ করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে অতর্কিত হামলা চালিয়েছিল তাতে শহীদ হন মধুসূদন দে। তার স্মৃতিকে ধরে রাখতেই মধুর ক্যান্টিনের মূল ফটকের সামনে তৈরি করা হয় এই ভাস্কর্য। ১৯৯৫ সালের ১৮ এপ্রিল ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করা হলেও পরবর্তীতে এর পুনর্নির্মাণ করা হয় ২০০১ সালের ২৭ মার্চ। এটি নির্মাণ করেছেন ভাস্কর মো. তৌফিক হোসেন খান।

‘রাজাকার ঘৃণাস্তম্ভ ভাস্কর্য’ : একাত্তরের রাজাকারদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ার সামনে নির্মাণ করা হয় এই ‘ঘৃণাস্তম্ভ’ ভাস্কর্যটি। ২ ফুট উচ্চতার কালো রঙের একটি স্তম্ভ এটি। মাথায় টুপির আদলে ত্রিভুজাকৃতি করা। এর তিন পাশে লেখা রয়েছে রাজাকার, আল বদর ও আল শামস। ভাস্কর্যের পেছনে লেখা রয়েছে- ঘৃণাস্তম্ভে রাজাকারদের ধিক্কার জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নির্মিত এ ভাস্কর্যটি কয়েক বছর ধরে জঞ্জালে ঢাকা পড়ে ছিল। কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর পরই রাজাকার ঘৃণাস্তম্ভটির আয়তন বাড়ানো হয়।

‘সপ্তশহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ : দেখতে ভাস্কর্যের মতো না হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের পুকুরের পূর্ব পাড়ে সাতজন বীরের প্রতিমূর্তি ভাস্কর্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ‘সপ্তশহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ ভাস্কর্যটি। মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর শিক্ষার্থীদের ছিল যুগান্তকারী ভূমিকা। তাদের অবদানকে স্মৃতিপটে ধারণ করে রাখতে এই স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়েছে ফজলুল হক মুসলিম হলে। এ সপ্তশহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নামক ভাস্কর্যটি সাতজন বীরশ্রেষ্ঠকে নিয়ে।

অতলান্তিকে বসতি : বনানীর নৌবাহিনী সদর দফতরের সামনের রাস্তায় স্থাপিত নান্দনিক ভাস্কর্য ‘অতলান্তিকে বসতি’। সিমেন্ট ও রড দিয়ে তৈরি নীলরঙা ভাস্কর্যটিতে সমুদ্রের নীল জলের আবহের পটভূমিতে সাঁতারের ভঙ্গিমায় ১৮টি ডলফিন, সোর্ড ফিশ ও হাঙ্গর রয়েছে। ২০০৮ সালে নিজের অর্থায়নে এটি নির্মাণ করেছেন প্রয়াত ভাস্কর মৃণাল হক। কিন্তু রাতের অন্ধকারে এটি ভেঙে ফেলে অজ্ঞাত হামলাকারীরা। এরপর এটির পুনরায় সংস্কার করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

রাজসিক : ২০০৮ সালে গৌরবময় ইতিহাসের ৪০০ বছর পার করে রাজধানী ঢাকা। চার শতাব্দী পূর্তিকে স্মরণীয় করে রাখতে ওই বছর রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের (তৎকালীন শেরাটন) সামনের রাস্তায় নিজের অর্থায়নে প্রয়াত শিল্পী মৃণাল হক নির্মাণ করেন ‘রাজসিক বিহার’ ভাস্কর্যটি। ঢাকার নবাবরা তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে রাজধানীতে ঘুরতে বের হওয়ার দৃশ্যটি এই ভাস্কর্যে তুলে ধরা হয়েছে।

কোতোয়াল : রাজধানীর মিন্টো রোডের প্রবেশমুখে স্থাপিত এই ভাস্কর্যটিতে ফুটে উঠেছে নবাবী আমলে ঢাকার পুলিশ বা তৎকালীন কোতোয়ালদের  ঘোড়ার গাড়িতে করে দায়িত্ব পালন করার দৃশ্য।

‘রত্নদ্বীপ’ : প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে স্থাপিত এই ভাস্কর্যটি নির্মিত হয় ২০০৮ সালে। এই ভাস্কর্যটিতে ঝিনুকের ভিতরের মুক্তার সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

বলাকা : রাজধানীর মতিঝিলে বিমান বাংলাদেশের পুরনো প্রধান কার্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে বাণিজ্যিক এলাকার শোভাবর্ধন করে চলেছে ‘বলাকা’ ভাস্কর্যটি। একদল বকের আকাশপানে তাকিয়ে উড়ে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছাকেই ভাস্কর্যে রূপদান করেছেন শিল্পের কারিগর।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর