রাজশাহী অঞ্চল থেকে হারিয়ে গেছে এক সময়ের সভ্যতার পরিচয় বহন করা সাত নদী। এখন যেগুলো টিকে আছে, তার মধ্যে ১১টিও মরতে বসেছে। হ্যারিটেজ রাজশাহীর সভাপতি মাহবুব সিদ্দিকীর গবেষণা গ্রন্থ ‘ফিরিয়ে দাও সেই প্রবাহ’তে শাসনের নামে মুছে ফেলা সাতটি নদীর বিস্তারিত বিবরণ আছে। নদীগুলো হচ্ছে নারদ, সন্ধ্যা, স্বরমঙ্গলা, দয়া, বারাহী, হোজা ও মুসা খান। সবকটি নদীর উৎসমুখ ছিল রাজশাহীতে।
শুষ্ক মৌসুম এলেই শুরু হচ্ছে পানির সংকট। তীব্র খরায় এখনই এ অঞ্চলের প্রধান ১৩ নদীর মধ্যে ১১টির তলদেশ পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। পুকুর, খাল-বিল মিলিয়ে অর্ধেকেরও বেশি জলাধার শুকিয়ে গেছে। রাজশাহী নগরীর তালাইমারী এলাকায় ছিল স্বরমঙ্গলা নদীর উৎসমুখ। খরস্রোতা এই নদীটি নগরীর কাজলা-জামালপুর ও নামোভদ্রা এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হতো। নদীটি রাজশাহীর পবা এলাকার ললিতাহার, ভালুকপুকুর, রামচন্দ্রপুর হয়ে ফলিয়ার বিলে গিয়ে পতিত হয়। এখন নদী বলে এর আর কোনো পরিচয় নেই। বারাহী নদীর উৎসমুখ রাজশাহী নগরীর ফুদকিপাড়া মহল্লায় পদ্মা থেকে। নগরীর ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া তিনটি নদীর এটি অন্যতম। বারাহী সম্পর্কে প্রথম তথ্যটি পাওয়া যায় উইলিয়াম উইলসন হান্টার রচিত স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব দ্য ডিস্ট্রিক্ট অব রাজশাহী গ্রন্থের ২৫ পৃষ্ঠায়। নদীটি পবা থানার মহানন্দখালী গ্রামে বারনই নদীতে গিয়ে পড়েছে। উৎস থেকে প্রথম পাঁচ কিলোমিটারে নদীর কোনো অস্তিত্ব নেই। দয়া নদীটি স্বরমঙ্গলা নদীর একটি শাখা। স্বরমঙ্গলা উত্তর-পশ্চিমমুখী হয়ে বর্তমান রুয়েট এলাকায় প্রবেশের ২০-২৫ গজ পুবে দয়া নামের নদীটি জন্ম নেয়। সেখান থেকেই দয়া উত্তরমুখী হয়েছে। নদীটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম দেয়াল বরাবর উত্তর দিকে বয়ে গেছে। এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম দেয়ালের পাশে তাকালে নদীর রেখা বোঝা যায়। ফলিয়ার বিল থেকে স্বরমঙ্গলা এবং দয়া নদীর সম্মিলিত প্রবাহটি হোজা নাম ধারণ করে রাজশাহীর দুর্গাপুর থানার পলাশবাড়ী গ্রামের মধ্য দিয়ে পূর্বমুখী প্রবাহ পথে তিন কিলোমিটার বয়ে যায়। এরপর উত্তরমুখী হয়ে বর্ধনপুর, চৌপুকুরিয়া, সিঙ্গা, দুর্গাপুর, পানানগর, দমদমা, চকপলাশী, গাঙধোপাপাড়া, গণ্ডগোহালি, গোবিন্দনগর হয়ে পুঠিয়ার কানাইপাড়ার মধ্য দিয়ে মুসা খান নদীতে পতিত হয়েছে। নারদ ঐতিহাসিক নদ। এর মোট তিনটি প্রবাহ। এর প্রথম প্রবাহ রাজশাহীতে, দ্বিতীয় এবং তৃতীয়টি নাটোরে। রাজশাহী শহর থেকে ৯ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে শাহপুর গ্রামে পদ্মা নদী থেকে এটির উৎপত্তি। শাহাপুর থেকে কাঁটাখালী, কাপাসিয়া, জামিরা, হলিদাগাছী, মৌগাছী, পুঠিয়ার তাতারপুর, বিড়ালদহ, ভাড়রা, কান্দ্রা পীরগাছা হয়ে নাটোরের ভিতর দিয়ে নন্দকুজা নদীতে পড়েছে। নারদের তৃতীয় প্রবাহটি নাটোরের বাগাতিপাড়ার আটঘরিয়া গ্রামের নন্দকুজা নদী থেকে উৎপত্তি লাভ করে ১৫ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে নাটোরের ধরাইল গ্রামে নারদের দ্বিতীয় প্রবাহে মিলিত হয়েছে। বর্তমানে এর উৎসমুখসহ প্রায় ১৫ কিলোমিটার অংশ সম্পূর্ণ বেদখল হয়ে ফসলি মাঠ ও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। বাকি অংশ এখনো নদীর আদলে মৃতপ্রায়।
সন্ধ্যা নদী নারদের একটি শাখা। এটির উৎসমুখ পুঠিয়া উপজেলার রঘুরামপুর বাগিচাপাড়ায়। পুঠিয়ার শিবপুর বাজারের পাশ দিয়ে বাঁশপুকুরিয়া, নন্দনপুর হয়ে কান্তার বিলে পতিত হয়েছে। মুসা খানের উৎসমুখ বড়াল নদ। নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া উপজেলার হাঁপানিয়া গ্রাম থেকে উৎপত্তি লাভ করে নদীটি রাজশাহীর পুঠিয়ার ঝলমলিয়া, কানাইপাড়া, নাটোরের আগদিঘা ছাতনি হয়ে ত্রিমোহনী নামক স্থানে এসে গদাই নাম ধারণ করে আত্রাই নদীর সঙ্গে মিশে চলনবিলে পড়েছে। নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী জানান, এই সাতটি নদীর হাজার হাজার হেক্টর সরকারি খাস জমি এখনো দখলমুক্ত আছে। বেদখল হওয়া জমিগুলো উদ্ধার ও খনন করে বর্ষার পানি ধরে কৃষিকাজে ব্যবহার করা সম্ভব। একই সঙ্গে খুলে দিতে হবে এ নদীগুলোর উৎসমুখ। প্রবাহ ফিরিয়ে দিয়ে নদীগুলো শাসন করা সম্ভব বলেও তিনি মনে করেন। রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোকলেছুর রহমান জানান, রাজশাহী পানিবিজ্ঞান উপবিভাগের আওতায় রাজশাহী বিভাগের ১৩টি প্রধান নদীর মধ্যে ১১টি নদীর অবস্থা খারাপ। হারিয়ে যাওয়া নদীগুলো ফিরিয়ে আনা আর সম্ভব নয়। তবে যেগুলো আছে, সেগুলো রক্ষায় কাজ করছে সরকার।