গত ২৪ মার্চ রাজধানীর মোহাম্মদপুর টাউন হল সংলগ্ন এক ব্যবসায়ীর বাসায় দুই সন্ত্রাসী ঢুকে গুলি করে পালিয়ে যায়। গত ২৯ এপ্রিল ফের ওই বাসাতেই গুলির ঘটনা ঘটে। এক মাসের ব্যবধানে একটি বাসায় দুই দফায় গুলির ঘটনার পর থেকে আতঙ্কে দিন পার করছেন ব্যবসায়ী মনির হোসেন ও তার পরিবারের সদস্যরা।
গত ২০ মার্চ দিবাগত রাত ৯টার দিকে রাজধানীর গুলশান এলাকায় দুর্বৃত্তের গুলিতে টেলি সুমন (৩৫) নামের এক যুবককে ফিল্মি স্টাইলে খুন করে দুর্বৃত্তরা। সুমন নামের ওই যুবক পুলিশ প্লাজার উত্তর পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেখানে কয়েকজনের সঙ্গে হঠাৎ তার ধস্তাধস্তি হয়। তাদের হাত থেকে বাঁচতে তিনি দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। একপর্যায়ে তাকে ধরে উপর্যুপরি চার রাউন্ড গুলি করে দুর্বৃত্তরা। ওই ঘটনার দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। গত শুক্রবার রাতে রাজধানীর পশ্চিম শেওড়াপাড়ায় বিমান সচিব নাসরিন জাহানের বাবার বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক ঘটেই চলছে নৃশংস হত্যাকাণ্ড, গুলি, ধর্ষণ ও চাঁদাবাজির মতো ঘটনা। বেড়েছে অপহরণ। মার্চ মাসেই ৮৩ জন অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে দুজনের বেশি অপহৃত হয়েছেন। তবে পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, প্রতিটি অপহরণের ঘটনায় মামলা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কাজ চলছে। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির তথ্য বলছে, এপ্রিল মাসে ৭৮টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১১ জন। আহত হয়েছেন ৭২৭ জন। আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক প্রতিশোধ পরায়ণতা, চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন স্থাপনা দখল কেন্দ্রিক অধিকাংশ সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এপ্রিলে গণপিটুনির ২২টি ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১২ জন এবং আহত হয়েছেন ২১ জন। এপ্রিলে ১৯৬ নারী ও কন্যা শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮৮ জন। যাদের মধ্যে ৫২ জন ১৮ বছরের কম বয়সি শিশু। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ছয়জনকে। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এ এন এস নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। জানা গেছে, গত ২২ এপ্রিল বাগেরহাটের মোল্লাহাট থেকে শ্রীলঙ্কান তিন নাগরিককে অপহরণের ঘটনা ঘটে। এক দিন পর তাদের উদ্ধারসহ জড়িত সন্দেহে তিনজনকে আটক করে পুলিশ। গত ১৪ এপ্রিল নাটোরের বড়াইগ্রামে প্রথম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণ শেষে শ্বাসরোধে হত্যার পর মুখ ঝলসে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আট মাস পার হয়ে গেছে। এখনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং মাঠ প্রশাসনকে প্রত্যাশিত জায়গায় আনতে না পারাটা বড় ব্যর্থতা। এপ্রিলে বরিশালের উজিরপুর উপজেলায় ‘অনৈতিক সম্পর্কের’ অভিযোগ এনে যুবক-যুবতীকে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন করা হয়। একই মাসে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের সিলেট্যা বাজার এলাকায় গণপিটুনিতে নাদিম (৩৫) ও মাসুদ (২৯) নামে দুজন নিহত এবং সোহাগ (২৮) নামে একজন আহত হয়েছেন। ধর্ষণের মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে ডোমারের গোমনাতী মডেল একাডেমি নামের একটি কিন্ডারগার্টেনের অধ্যক্ষ মিজান আহমেদকে (৪২) বস্ত্রহরণ, মাথার চুল কেটে রং মাখিয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে বেধড়ক গণপিটুনির মাধ্যমে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ওমরাহ শেষে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে আসা নোয়াখালীর আবদুল কাদের মিলন নামের এক ব্যক্তিকে (৩৫) গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে শিকল দিয়ে হাত-পা বেঁধে ধর্ষণ ও পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এক গৃহবধূ। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, পতিত শেখ হাসিনার নির্দেশে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা নানা কৌশলে দেশের বিভিন্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে কাজ করছে। পরবর্তীতে ওইসব ঘটনার ধারণ করা ভিডিও এডিট করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। সম্প্রতি রাজধানীর কলাবাগান থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোক্তারুজ্জামানসহ (ওসি) তিন কর্মকর্তা প্রত্যাহারের ঘটনার নেপথ্যেও পতিত সরকারের এজেন্টরা কৌশলী ভূমিকা রেখেছে। ডিএমপি কমিশনারের কাছে অভিযোগ করা ড. ওয়াদুদের সঙ্গে পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ৫ আগস্টের পরও আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের বিষয়েও নানা অভিযোগ রয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের তুলনায় অনেক উন্নতি করেছে। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় বিশেষ মনিটরিং করা হচ্ছে।