কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ঢাকায় সহিংসতার আগে এক লাখ সিম ব্যবহারকারী হঠাৎ নতুন করে রাজধানীতে প্রবেশ করে বলে জানিয়েছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তিনি বলেন, ‘সেদিনই হামলা হয় সেতু ভবন, বিটিভি, মেট্রো রেল, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনসহ সরকারি গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থাপনায়। বিএনপি-জামায়াতের লোকজনের গতি-প্রকৃতি নাশকতার স্থানগুলোমুখী ছিল।’
গতকাল শনিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ডাক ভবনে সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫৪তম জন্মদিন উপলক্ষে সারা দেশে এক লাখ গাছের চারা রোপণে ‘শান্তির জন্য বৃক্ষ’ বা ‘ট্রি ফর পিস’ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রতিমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
পলক বলেন, বিভিন্ন জেলার যেসব স্থানে ‘রেড অ্যালার্ট’ জারি ছিল, সেখানে ১৮, ১৯ ও ২০ জুলাই কোনো সহিংসতা হয়নি। ঢাকার যে ১০ থেকে ১৫টি জায়গায় অতিরিক্ত ৫০ হাজার থেকে এক লাখ নতুন সিম কার্ডের ব্যবহারকারীরা আসে, সেগুলোর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, রেড অ্যালার্টভুক্ত এলাকার বিএনপি, ছাত্রদল, জামায়ত-শিবিরের চিহ্নিত ও তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীরা ঢাকামুখী ছিল এবং ঢাকায় তারা অবস্থান গ্রহণ করেছে। তাদের অবস্থানকালেই ১৮ থেকে ২১ জুলাই সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে।
মোবাইল অপারেটরদের তথ্য-উপাত্তের কথা উল্লেখ করে পলক বলেন, ‘তথ্য বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি, কিভাবে ১৮ জুলাই সকাল থেকে ঢাকা এবং ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকা-বিশেষ করে ঢাকার উত্তরা, রামপুরা, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী, নারায়ণগঞ্জ এবং গাজীপুরের এলাকাগুলোতে ঢাকার বাইরে থেকে নবাগত কিছু সিম কার্ডের আবির্ভাব ঘটে।
তথ্য-প্রযুক্তি উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এটা পরিষ্কার, যেসব জেলায় ২০১১, ২০১২, ২০১৪, ২০১৫ সালে বিএনপি, জামায়াত, শিবির, ছাত্রদলের যারা সন্ত্রাস করেছিল, সেই সব জেলা—গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ, রংপুরের মিঠাপুকুর, নিলফামারী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরার অন্তত ২০টি স্পট, সেগুলোতে রেড অ্যালার্ট জারি ছিল। সেই সব জায়গায় ১৮, ১৯ এবং ২০ জুলাই কোনো সহিংসতা হয়নি।’
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘সেই সব এলাকার কিছু মোবাইল ফোন সিম শিফট করে ঢাকায় চলে আসে। ঢাকার ১০-১৫টি জায়গায় অতিরিক্ত প্রায় ৫০ হাজার থেকে এক লাখ নতুন সিম কার্ডের আবির্ভাব ঘটে।
এগুলোর তথ্য-উপাত্ত এবং সূত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, সেই সব এলাকার অনেক বিএনপি, ছাত্রদল, জামায়াত, শিবিরের চিহ্নিত এবং তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীরা এই কয়েক দিন ঢাকার মধ্যে ছিল। এসব এলাকায় তারা অবস্থান নেয়।’
পলক বলেন, ‘আমরা আরো তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করছি। তারা কখন মহাখালী ডাটা সেন্টার, ত্রাণ পুনর্বাসন অধিদপ্তরের সার্ভার, সেতু ভবনের সার্ভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোলপ্লাজায় দুই-তিন দফায় হামলা করেছে। বিটিভির সদর দপ্তরে তারা হামলা করেছে, পুড়িয়েছে, সাধারণ কর্মীদের আক্রমণ করেছে, লুটপাট করেছে।
কোনো সাধারণ শিক্ষার্থী কম্পিউটার, সিপিইউ, টিভি লুটপাট করেনি। বিটিভিতে গিয়ে সন্ত্রাসীরা নিয়ন্ত্রণকক্ষ খুঁজেছে। তারা হয়তো চিন্তা করেছিল, সেখান থেকে কোনো ঘোষণা দিতে কিংবা কোনো কিছু করতে চেয়েছিল।
জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ‘তারা সিসিটিভি ক্যামেরা ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তার পরও যতটুকু দেখা যায়, তাতে এটা পরিষ্কার যে তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ ও যৌক্তিক আন্দোলন যখন সফল হয়ে গেছে, যখন সরকার মেনে নিয়েছে, আদালত রায় দিয়েছেন, সেই সময় ১৮ জুলাই বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এই হামলাগুলো করা হয়েছে।’
সরকারের পক্ষ থেকে ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়নি দাবি করে পলক বলেন, ‘ঢাকা বিভাগের ১৭টি জায়গায় হামলা হয়েছে। মহাখালীতে তিনটি ডাটা সেন্টারে ১৮টি আইআইজির সিস্টেম রয়েছে। সেখানে থাকা আইএসপির ৭০ শতাংশ সার্ভার থাকে। তাই ইন্টারনেট একা একাই বন্ধ হয়েছে। আমরা বন্ধ করিনি।’
তথ্য-প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘রবিবার সকাল ৯টায় আমরা মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন এমটবের সঙ্গে বৈঠক করব। বৈঠকে সন্তুষ্ট হলে রবি-সোমবার মোবাইলের ফোরজি নেটওয়ার্ক খুলে দেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ইন্টারনেট শাটডাউন করিনি। ইন্টারনেট বন্ধ হয়েছিল তিনটি ডাটা সেন্টার ও শত শত কিলোমিটার তার পুড়িয়ে দেওয়ার জন্য। এ জন্য শুধু টেলিকম খাতে ৫০০ কোটি টাকা এবং সব মিলিয়ে এক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।’
বিটিআরসির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, টেলিযোগাযোগ খাতে আঘাত আসায় এখনো কিছু ক্যাশ সার্ভার মেরামতের কাজ চলছে। হয়তো দুই-চার দিনের মধ্যে টেলিযোগাযোগ পুরোপুরি আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। দেশে থাকা চার হাজারের ওপর ক্যাশ সার্ভার ঠিক হতে সময় লাগবে। গুগলের সব ক্যাশ সার্ভার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে।
ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সভাপতি এমদাদুল হক বলেন, ‘ইন্টারনেট এখন আমাদের মৌলিক অধিকার। কিন্তু দুর্বৃত্তদের হামলায় মহাখালীতে সার্ভার ও তার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন ছিল। এই সেবা এখন ধীরে ধীরে চালু হচ্ছে। শিগগিরই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। ৯০ শতাংশ সমস্যা রিস্টোর করা হয়েছে। বাকিটা নির্ভর করছে ট্রান্সমিশনের ওপর।
ডাক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক তরুণ কান্তি সিকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তথ্য-প্রযুক্তি সচিব মো. সামসুল আরেফিন, ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব মুশফিকুর রহমান ও বিটিআরসি চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মহিউদ্দিন আহমেদ।
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমোসহ অন্যান্য অ্যাপে প্রবেশ করা যাচ্ছে না।
১৭ জুলাই থেকে সারা দেশে মোবাইল ইন্টারনেট তথা ফোরজি প্রায় পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর আগে ১৬ জুলাই সন্ধ্যায় আংশিকভাবে বিভিন্ন স্পটে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর পাঁচ দিন পর গত মঙ্গলবার রাত থেকে গুরুত্বের ভিত্তিতে সীমিত আকারে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু করা হয়।