শনিবার, ১০ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

ফাইনাল নয় যেন মহাযুদ্ধ

ফাইনাল নয় যেন মহাযুদ্ধ

ফুটবলের সঙ্গে অন্য খেলার যে তুলনা চলে না, তার আবার প্রমাণ মিলল। বিশ্বকাপ নয়, তবু কোপা আমেরিকা ও ইউরোজুড়ে যে উন্মাদনা তৈরি হয়েছে তা বিশ্বকাপের চেয়েও কোনো অংশে কম নয়। আমি যদি দুই টুর্নামেন্টকে স্বপ্নের বিশ্বকাপের সঙ্গে তুলনা করি, তা কি ভুল হবে? একটা ব্যাপার সবাইকে স্বীকার করতে হবে, অতীতে হয়েছে, সামনেও হবে। যে দেশই বিশ্বকাপই জিতুক তা ইউরোপ ও ল্যাটিনদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, এ নিয়ে সংশয় নেই। এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের বিশ্বকাপ জেতার সামর্থ্য নেই। সেই ক্ষেত্রে কোপা কিংবা ইউরোকে কাতার বিশ্বকাপের ড্রেস রিহার্সেলই বলা যায়। দুটো টুর্নামেন্ট একসঙ্গে হচ্ছে। স্বপ্নের তারকারা অংশ নিচ্ছেন। যে উন্মাদনা তাতে করোনাভাইরাস যেন হার মেনেছে। সব ভয়কে জয় করে ইউরোতে দর্শকরা গ্যালারিতে নিজ নিজ দেশকে সমর্থন দিচ্ছেন।

ম্যাজিক আর আনন্দ-বেদনার মধ্য দিয়ে দুটি টুর্নামেন্টই সফলভাবে শেষ হতে চলেছে। বাফুফের সভাপতি হিসেবে আয়োজকদের আমি ধন্যবাদ জানাই। একটা বিষয় না বললে নয়- কেউ কেউ মাঝে-মধ্যে বলেন, বাংলাদেশের ফুটবল শেষ হয়ে গেছে, একে আর বাঁচানো সম্ভব নয়। আমি কেন, অনেকেই এমন মন্তব্যে শুধুই হাসেন। যে ফুটবল বাঙালির রক্তে মিশে গেছে তা শেষ হয় কীভাবে?

অনেক দিন পর আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল শিরোপা লড়াইয়ে মুখোমুখি হচ্ছে। একে ফুটবলপ্রেমীরা স্বপ্নের ফাইনাল বলছেন। আমিও এর সঙ্গে একমত। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সত্যিই স্বপ্নের ফাইনাল। কোপায় দুই দেশ এর আগেও ফাইনাল খেলেছে। কিন্তু এবারের আবেগ অন্যরকম। আর তা মেসি-নেইমারকে ঘিরে। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ফাইনাল ঘিরে বাংলাদেশে যে উত্তেজনা বিরাজ করছে তা ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনাতেও দেখা মিলবে না। রাত পোহালেই দুই বিশ্বচ্যাম্পিয়নের মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। উড়ছে দুই দেশের পতাকা। সমর্থকরা এখনই প্রিয় দলের জার্সি গায়ে চড়িয়েছেন। ক্ষণিকের জন্য হলেও বাংলাদেশ যেন আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলে পরিণত হবে। একই অবস্থা পুরো বিশ্বেই। নেইমার না মেসিরা চ্যাম্পিয়ন হবেন- এ নিয়ে দুই দেশের সমর্থকদের মধ্যে তুমুল উত্তেজনা বিরাজ করছে।

শুধু কোপা নয়। ইউরো কাপের ফাইনাল নিয়েও উত্তেজনার কমতি নেই। কোপায় দুই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন যেমন ফাইনাল খেলছে। তেমনি ইউরোতেও অভিন্ন দৃশ্য। ইউরো ফাইনালের উন্মাদনার প্রধান কারণ হচ্ছে ফুটবলে এই প্রথম ইতালি ও ইংল্যান্ড ফাইনালে মুখোমুখি হচ্ছে। স্বপ্নের এক ফাইনাল। ব্যর্থতার বৃত্তে বন্দী থাকায় ইংল্যান্ড যে ১৯৬৬ সালে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তা অনেকে ভুলতে বসেছিলেন। এবার হ্যারিকেইনরা ইউরোকাপে ফাইনালে উঠে সেই স্মৃতি শুধু মনে করিয়ে দিচ্ছেন না, প্রথমবারের মতো ইউরো জয়ের অপেক্ষায় রয়েছেন।

ফুটবলে বাংলাদেশের ভালোবাসা দেখে সত্যিই আমি অভিভূত। আমার বিশ্বাস, দুই টুর্নামেন্ট ঘিরে যে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছে তাতে আমাদের ফুটবলেও উপকারে আসবে। ফুটবলাররা শুধু টিভির দিকে চেয়েই থাকেননি। আমার বিশ্বাস, কিছু শিখতেও পারবেন। ফুটবল যে শেষ হয়নি, তা কি প্রমাণ মিলেছে? আরেকটা কথা না বললে নয়, ফুটবল যদি শেষই হতো তাহলে দেশের বড় বড় করপোরেট হাউসগুলো এ খেলার ব্যাপারে এতটা আগ্রহী হয়ে উঠছে কেন?

যাক, এবার আসি শিরোপা প্রসঙ্গে। অনেকে আমাকে বলছেন, কে চ্যাম্পিয়ন হবে- আর্জেন্টিনা না ব্রাজিল কিংবা ইংল্যান্ড না ইতালি? ভাই দীর্ঘদিন ফুটবল খেলেছি। কোচ ছিলাম, এখন ফেডারেশনের সভাপতি। অল্প হলেও তো অভিজ্ঞতা হয়েছে। তবু বলব, কে যে চ্যাম্পিয়ন হবে তা বলা মুশকিল। সোজা কথা এ প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। এখানেই আমি বড্ড অসহায়।

মেসির পাহারায় কাসেমিরো

ছয়বারের বিশ্বসেরা ফুটবলার লিওনেল মেসির অপেক্ষা শুধু একটি ট্রফির। সেই অপেক্ষার কি মধুর সমাপ্তি ঘটবে? রবিবার বাংলাদেশ সময় সকালে কোপা আমেরিকার শিরোপা জিতলেই বিশ্বমঞ্চে প্রথমবারের মতো ট্রফি উঁচিয়ে ধরবেন মেসি। ব্যর্থতা ঘুচবে আগের চারবার ফাইনাল খেলে চ্যাম্পিয়ন হতে না পারার। কাজটি কিন্তু সহজ নয়। প্রতিপক্ষ যখন পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন এবং বর্তমান কোপা চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। সেলেকাওদের হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হতে মেসিকে যেমন হারাতে হবে ব্রাজিলকে। ঠিক একইভাবে ব্যারিয়ার টপকাতে হবে ব্রাজিলিয়ান অধিনায়ক কার্লোস হেনরিক কাসেমিরোর হিমালয়সম দৃঢ়তার রক্ষণভাগ। জাতীয় দলের পতাকায় মেসি ও কাসেমিরো প্রবল প্রতিপক্ষ।

ঠিক একইভাবে ক্লাবের জার্সিতেও প্রতিপক্ষ। দুজনেই আবার একে অপরের পরিচিত। স্প্যানিস লা লিগায় মেসি খেলেন বার্সেলোনায়। কাসেমিরো খেলেন রিয়াল মাদ্রিদে। সেই হিসেবে দুজনেই পরস্পরের শক্তিশালী ও দুর্বল দিকগুলো সম্পর্কে ধারণা রাখেন। চলতি মৌসুমে লা লিগায় দুই চিরপ্রতিপক্ষ ক্লাবের হয়ে খেলেছেন। রবিবার বিখ্যাত মারাকানা স্টেডিয়ামে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মহারণের আড়ালে যেমন লড়াই হবে মেসি ও নেইমারের। তেমনি ফুটবলপ্রেমীদের আলাদা নজর থাকবে মেসি ও কাসেমিরোর বাড়তি লড়াইয়ে।

 নেইমারকে আটকাবেন পারদেস

বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো ও ঐতিহাসিক ফুটবল টুর্নামেন্ট কোপা আমেরিকা কাপ। লাতিন আমেরিকার সেরা দল হতে রবিবার ভোরে ফাইনালে মুখোমুখি হচ্ছে নেইমারের ব্রাজিল ও লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বীর ফাইনাল দেখতে মুখিয়ে গোটা বিশ্ব। দুই দলের আড়ালে নেইমার ও মেসির আরও একটি লড়াই দেখতে উদগ্রীব হয়ে আছেন ফুটবলপ্রেমীরা। তবে দুই তারকার লড়াইকে আড়াল করবেন প্যারিস সেন্ট জার্মেইনের (পিএসজি) দুই সতীর্থ নেইমার ও লিওনার্দো পারদেস। দুই ক্লাবমেট নেইমার ও পারদেস কোপার ফাইনালে আবার প্রবল প্রতিপক্ষ। ব্রাজিলের শিরোপা ধরে রাখার মিশনে নেতৃত্ব দেবেন নেইমার। তাকে আটকে রাখার দায়িত্ব পেয়েছেন তারই ক্লাব সতীর্থ পারদেস।

নেইমারকে কোচ তিতে খেলান লেফট উইংয়ে। পারদেসকে আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনি খেলান ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে। দুজনে ক্লাব সতীর্থ বলেই একে অপরের শক্তিশালী ও দুর্বল দিকগুলো জানেন। ফলে নেইমারকে আটকানোর পরিকল্পনা তাকে ঘিরেই করেছেন স্কালোনি। ১৯৯৩ সালের পর আর্জেন্টিনাকে শিরোপা উৎসবে মাততে জীবন বাজি রাখতেও প্রস্তুত পারদেস। নেইমার চাইছেন ব্রাজিলকে টানা শিরোপা উৎসবে মাতাতে।

রণকৌশল

আর্জেন্টিনা

এমিলিয়ানো মার্টিনেজ, মোলিনা, পেজ্জেল্লা, ওতামেন্ডি, ট্যাগলিয়াফিকো, ডি পল, প্যারেডেস, লো সেলসো, লিওনেল মেসি, লটারো মার্টিনেজ ও গনজালেস।

আর্জেন্টাইন কোচ লিওনেল স্কালোনি মাঠে দল নামান ৪-৩-৩ ফরমেশনে। সম্মুখ সারিতে লিওনেল মেসি ও লটারো মার্টিনেজের সঙ্গে থাকেন গনজালেস। অবশ্য কখনো কখনো যোগ হন সার্জিও আগুয়েরো। লিওনেল মেসিই রণকৌশলে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসেন। তিনি ফরোয়ার্ড লাইন থেকে প্রায়ই নিজেদের অর্ধে নেমে যান। ঘন ঘন স্থান বদল করেন। এতে প্রতিপক্ষের জন্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে খেলা কঠিন হয়ে যায়।

 

রণকৌশল

ব্রাজিল

এডারসন,  ড্যানিলো, মারকুইনহস, থিয়াগো সিলভা, স্যানড্রো, ফ্রেড, কাসেমিরো, রিচার্লিসন, লুকাস পাকুয়েতা, এভারটন ও নেইমার।

ব্রাজিলিয়ান কোচ তিতের পছন্দের ফরমেশন ৪-২-৩-১। অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে নেইমার, এভারটন ও লুকাসকে রেখে সেন্টার ফরোয়ার্ড অদল-বদল করেন তিনি। ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় শক্তি গতি। কোপা আমেরিকায় তারা দারুণ গতিশীল ফুটবল খেলেছে। পাশাপাশি তারা পূর্বপুরুষদের ফুটবল ছন্দও দেখিয়ে চলেছে প্রতি ম্যাচে। আর্জেন্টিনার সামনে নেইমারদের গতি ও ছন্দই বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে ফাইনালে।

 

তিতের অধীনে ব্রাজিল ৬০ ম্যাচ খেলেছে। এর মধ্যে ৪৫টিতেই জয় পেয়েছে সিলেকাওরা। ড্র করেছে ১১ ম্যাচে। পরাজিত হয়েছে কেবল চারটিতে। এই ৬০ ম্যাচে ব্রাজিল ১২৬ গোল করার বিপরীতে মাত্র ২১টি গোল হজম করেছে।

 

টানা ১৩ ম্যাচ অপরাজিত থেকে ফাইনাল খেলতে নামছে ব্রাজিল। গত ১৩ ম্যাচের ১২টিতেই জয় পেয়েছে পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। একবার ড্র করেছে।

 

কোপা আমেরিকায় তিতের অধীনে ব্রাজিল ১২ ম্যাচ খেলে ৯টিতেই জয় পেয়েছে। কোপা আমেরিকায় এখনো কোনো ম্যাচে হারেননি কোচ তিতে।

 

লিওনেল স্কালোনির অধীনে আর্জেন্টিনা ৩৪ ম্যাচ খেলেছে। এর মধ্যে ২০টিতেই জয় পেয়েছে আলবেসিলেস্তরা। ড্র করেছে ১০টিতে। হেরেছে চার ম্যাচে। এ ৩৪ ম্যাচে আর্জেন্টিনা ৬৪ গোল করার বিপরীতে ২৫ গোল হজম করেছে।

 

১০ বার কোপা আমেরিকায় চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপের ট্রফি ভাগাভাগি করেছে আর্জেন্টিনা (৮) ও ব্রাজিল (২)। এর মধ্যে সরাসরি ফাইনাল হয়েছে তিনবার। বাকি সাতবার রাউন্ড রবিন পদ্ধতিতে খেলা হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর