দিন দিন সমস্যাটা বেড়েই চলেছে। অথচ এ নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। হ্যাঁ, ঢাকা শহরে খেলার মাঠগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। ছেলেরা যে খেলায় ব্যস্ত থাকবে সে উপায়ও নেই। কারণ মাঠ কই? ঢাকা শহরে এক সময়ে আনাচে-কানাচে মাঠ ছিল। বিকাল বেলায় দেখা যেত ফুটবল, ক্রিকেট না হয়ে অন্য খেলা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে স্কুল বা কলেজ পড়ুয়া ছেলেরা। বিকাল বেলায় স্কুল থেকে ফিরে বাসায় আর মন থাকত না। সোজা চলে যেত মাঠে খেলতে। মাগরিবের আগেই খেলা শেষ করে সবাই আবার বইখাতা নিয়ে বসে পড়ত। এখন কি সেই দৃশ্য দেখা যাবে? যাকে আপনি জিজ্ঞাসা করবেন বিরক্ত হয়ে বলবে খেলব কোথায়, মাঠ কি আছে? আসলে রাজধানীতে মাঠ সমস্যাটা এত প্রকট হয়ে উঠেছে যে, এ নিয়ে নগরবাসীর দুশ্চিন্তার শেষ নেই। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে নব্বই দশক পর্যন্ত বছরে এক বা দুই বার করে আন্তঃস্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট হতো। তখন ফুটবলে জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া ছিল বলেই স্কুলগুলো মূলত ফুটবল নিয়ে ব্যস্ত থাকত। এলাকা ভাগ করে টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হতো। এখান থেকেই নতুন নতুন ফুটবলারের সন্ধানও মিলত। খোরশেদ বাবুল, কায়সার হামিদ, ছাইদ হাছান কাননদের মতো তারকারা আন্তঃস্কুল থেকেই ফুটবলের যাত্রা করেছিলেন।
বর্তমানে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া হলেও কোথাও কোনো আন্তঃস্কুল টুর্নামেন্টের দেখা নেই। আসলে খেলা হবে কীভাবে। কারণ অধিকাংশ স্কুলগুলোতেও মাঠ নেই। এলাকায় যেসব মাঠ আছে ক্রিকেট একাডেমি খুলে সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। মাঠে এখন ভবন নির্মাণ করে স্কুলের পাশাপাশি কলেজও খোলা হচ্ছে। সবাই এখন বাণিজ্যিক চিন্তা নিয়েই ব্যস্ত। ছেলে বা মেয়েদের যে খেলার সুযোগ করে দিতে হবে সে চিন্তা কারও মাথায় নেই। মাঠের অভাবে খেলতে পারছে না বলে ধনী ঘরের ছেলেরা কম্পিউটার নিয়ে ব্যস্ত থাকছেন। সারাক্ষণ কম্পিউটার নিয়ে নাড়াচাড়া করাতে অনেকে আবার মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এ তো গেল ধনীর ঘরের কথা। দরিদ্র ঘরের কথা চিন্তা করুন- মাঠ না থাকাতে তারা কী সমস্যায় ভুগছে। ঢাকা শহরে শুধু বিকাল বললে ভুল হবে। ভোর থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত যাদের বল নিয়ে ছোটাছুটি করতে দেখা যেত তারা অধিকাংশ দরিদ্র ঘরেই। এক জরিপে দেখা গেছে মাঠের অভাবে দরিদ্র ঘরের ছেলেরা নানা অপকর্মে জড়িয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের সংকটে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ও সিটি করপোরেশনের অনেক দায়িত্ব থাকলেও তারা নীরব হয়ে বসে আছে। ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সহযোগী হিসেবে মূলত ক্রীড়া পরিষদ গঠন করা হয়েছে। তাদের মূল দায়িত্ব ক্রীড়া উন্নয়ন। মাঠ না থাকলে খেলাধুলার উন্নতি ঘটানো সম্ভব না, তা কি তারা জানেন না। যেখানে তারা মাঠ বাড়াবে সেখানে কিনা অবকাঠামো নির্মাণে ব্যস্ত আছে ক্রীড়া পরিষদ। কথায় কথায় তারা মাঠকে স্টেডিয়ামে রূপান্তরিত করছে। স্টেডিয়ামের প্রয়োজনীয়তার কথা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু এর পাশাপাশি মাঠের সংখ্যা বাড়ালে কোনো কথা উঠত না। স্টেডিয়াম মানেই মাঠ সংরক্ষিত হয়ে যাওয়া। সেখানে সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েদের খেলার সুযোগ নেই। কমলাপুরে স্টেডিয়াম নির্মাণের আগে সেই মাঠে প্রতিদিন শত শত ছেলেমেয়েদের ভিড় লেগে থাকত। পল্টন ময়দানের কথা চিন্তা করুন। মূল স্টেডিয়ামের বাইরে মাঠ যখন উন্মুক্ত ছিল তখন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত তরুণদের খেলার হিড়িক পড়ে যেত। কমলাপুর ও পল্টনে যারা থাকেন তাদের কী অবস্থা। ছেলেমেয়েরা মাঠের অভাবে বেরই হতে পারে না। পুলিশ সূত্রেই জানা গেছে কমলাপুর স্টেডিয়ামে রূপান্তরিত হওয়ার পর ওই এলাকায় অপরাধের মাত্রা অনেক গুণ বেড়ে গেছে। মাঠের অভাবেই তরুণরা বিপদগামী হয়ে উঠছে। সবচেয়ে বিস্ময় ব্যাপার ফুটবল, ক্রিকেট ও হকি লিগে যেসব ক্লাব খেলে তারা মাঠের অভাবে অনুশীলন করতে পারছে না। পেশাদার লিগে বাধ্যতামূলক হলেও কটি ক্লাবের নিজস্ব মাঠ আছে? জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ বিষয়টি নিয়ে যদি না ভাবে, তাহলে বাংলাদেশের খেলাধুলা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। কারণ মাঠ না হলে খেলা হবে না। আর খেলা না হলে নতুন খেলোয়াড়ের সন্ধান মিলবে না। নগরবাসীর সেবার জন্যই সিটি করপোরেশন গঠন হয়েছে। কই তারাও তো ব্যাপারটি নিয়ে উপলব্ধি করছে না। ঢাকা শহরে থানাগুলোতে খেলার উপযোগী কোনো মাঠ আছে কিনা তা কি তারা কখনো জরিপ করে দেখেছে।