নেদারল্যান্ডসবাসী এখনো আফসোস করেন ১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপ নিয়ে। ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির বিরুদ্ধে মাত্র দুই মিনিটেই ক্রুইফের সৌজন্যে পেনাল্টি পায় নেদারল্যান্ডস। ডাচ তারকা নিজে শট না করে সুযোগ দেন সতীর্থ নেসকেনকে। গোল হয় ঠিকই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ২-১ গোলে হেরে যায় নেদারল্যান্ডস। ফাইনাল ম্যাচে কেন যে ক্রুইফ নিজে পেনাল্টি শটটি করলেন না! কেননা ক্রুইফের গোল করা কোনো ম্যাচেই হারেনি নেদারল্যান্ডস। তাই পশ্চিম জার্মানির বিরুদ্ধে ওই পেনাল্টি গোলটি ক্রুইফের পা থেকে এলে হয়তো আর দুর্ভাগ্য স্পর্শ করতে পারত না ডাচদের। সেই আফসোসে এখন পুড়ছেন নেদারল্যান্ডসবাসী!
দেশকে বিশ্বকাপের শিরোপা এনে দিতে না পারলেও '৭৪-এর বিশ্বকাপে ক্রুইফ জাদুকরী ফুটবল উপহার দিয়ে সমর্থকদের মন জয় করে নিয়েছেন ঠিকই। তাছাড়া ওই বিশ্বকাপে সেরা ফুটবলারের পুরস্কারও পেয়েছেন এই ডাচম্যান। শুধু তাই নয়, ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপের বাছাই পর্বের গণ্ডিও পার করে দিয়েছেন ক্রুইফ। কিন্তু অজ্ঞাত এক কারণে বিশ্বকাপের এক বছর আগে হঠাৎ করে দুর্দান্ত ফর্ম থাকা সত্ত্বেও ৩০ বছর বয়সী ক্রুইফ অবসর নেন। তখন এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলেননি। কিন্তু ২০০৮ সালে হঠাৎ অবসরের বিষয়ে মুখ খুলেন ক্রুইফ। ডাচ তারকা নাকি ১৯৭৭ সালে বাধ্য হয়েই অবসর নিয়েছিলেন। তাকে এবং তার পরিবারকে অপহরণ করার হুমকি দিয়েছিল দেশের প্রভাবশালী এক মহল। ক্রুইফ বলেছেন, 'কখনো কখনো এমন মুহূর্ত আসে যখন ফুটবলের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় অন্য বিষয়। বিশ্বকাপে খেলতে হলে অবশ্যই ২০০ ভাগ ফিট থাকতে হয়। কিন্তু আমি যে অবস্থায় ছিলাম, তা ছিল ভয়াবহ।'
অবশ্য ক্রুইফকে ছাড়াই '৭৮-র বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছিল নেদারল্যান্ডস। কিন্তু শিরোপা জিততে পারেনি। ফাইনালে আর্জেন্টিনার কাছে হেরে যায়। ক্রুইফ থাকলে হয়তো জিতেই যেত ডাচরা_ এমন আফসোস ছিল দেশবাসীর। ২০১০ সালেও দুর্ভাগ্য তাড়া করে ফেরে ডাচদের। বিশ্বকাপের ফাইনালেও ভালো খেলে নেদারল্যান্ডস হেরে যায় স্পেনের কাছে। ফুটবল বিশ্বে নেদারল্যান্ডসই একমাত্র হতভাগা দেশ, যারা তিন তিনবার ফাইনালে উঠে ভালো খেলেও শিরোপা জিততে পারেনি। তবে এবার শিরোপা জয়ের লক্ষ্য নিয়েই ব্রাজিলে পাড়ি জমাবেন ডাচরা। গ্রুপ-বি'তে তাদের প্রতিপক্ষ স্পেন, চিলি ও অস্ট্রেলিয়া।
হাঙ্গেরির পুসকাসের সঙ্গে ক্রুইফের অনেক মিল ছিল। একাই গ্রহান্তরের ফুটবল উপহার দিয়ে অপরাজিত থেকেই হাঙ্গেরিকে ফাইনালে '৫৪-র বিশ্বকাপে তুলেছিলেন পুসকাস। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেননি। পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে হেরে স্বপ্নভঙ্গ। তবে সেরা ফুটবলারের পুরস্কার পেয়েছিলেন পুসকাস। '৭৪-এ ক্রুইফের অবস্থাও একই। ঘাতক সেই পশ্চিম জার্মানি। সেবার নেদারল্যান্ডস উরুগুয়ে (২-০), বুলগেরিয়া (৪-১), আর্জেন্টিনা (৪-০), পূর্ব জার্মানি (২-০) এবং ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের (২-০) মতো দলকে উড়িয়ে দিয়ে ফাইনালে উঠেছিল। তারপর ছন্দপতন। তবে নেদারল্যান্ডসকে বিশ্বকাপ শিরোপা এনে দিতে না পারলেও সবার মন জয় করে নিয়েছেন ঠিকই। তাই তো বিশ্বকাপ না জিতেই ফুটবলের মহানায়ক ইয়োহান ক্রুইফ।
১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপের আগে ফুটবল খেলা হতো 'জাম্বুরা স্টাইল'-এ। খেলোয়াড়রা তাদের নিজ নিজ অবস্থান অাঁকড়ে ধরে থাকত। ডিফেন্ডার কখনো ফরোয়ার্ড পজিশনে যেতেন না, আবার স্ট্রাইকারকে কখনো ডিফেন্সে দেখা যেত না। কিন্তু ক্রুইফ এসে ব্যাপক পরিবর্তন আনেন। চালু করেন 'টোটাল' ফুটবল। অর্থাৎ যে কোনো খেলোয়াড় প্রয়োজনে যে কোনো পজিশনে খেলতে পারবেন। ঝিমিয়ে পড়া ফুটবলে যেন গতি চলে আসে। আর এ কারণেই ইয়োহান ক্রুইফকে বলা হয় 'টোটাল' ফুটবলের জনক। শুধু তাই নয়, '৭৪-র বিশ্বকাপে ক্রুইফ তো নতুন বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। ফুটবলে একটা অলিখিত নিয়ম ছিল, খেলোয়াড়দের প্যান্ট হবে হাঁটু পর্যন্ত। আর জার্সিতে অবশ্যই 'কোলার' থাকতে হবে। কিন্তু ক্রুইফের কারণেই '৭৪-র বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের ফুটবলাররা এই দুই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়েছিলেন। ডাচরা প্রথম কোলার ছাড়া জার্সি এবং শর্ট প্যান্ট পরে খেলতে নামে। তারপর থেকে অন্য দলগুলোও তা অনুসরণ করে। ১৯৭৪ সালের পর থেকে ঢাকার মাঠেও শুরু হয়ে যায় টোটাল ফুটবল। তবে প্রথম শুরু করে ঢাকা আবাহনী।
ক্রুইফ নেদারল্যান্ডসের জার্সিতে ৪৮ ম্যাচে ৩৩ গোল করেছেন। পেলে-ম্যারাডোনার পর ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে বড় তারকা তিনি। তাই তো বিশ্বকাপ না জিতেও ইয়োহান ক্রুইফ ফুটবলের মহানায়ক।