শেষ ওভারটা কোহালিকে করতে দেখে হুট করে একসঙ্গে দু’টো অনুভূতি হল। এই বিরাট সিদ্ধান্তটা কি ধোনির স্ট্র্যাটেজিক্যাল? না, কপালের নামে ছেড়ে দেওয়া! না কি এমন প্রেসার কুকার পরিস্থিতিতে ধোনির বারো বছর বয়সের ধূসর স্মৃতিও মনে পড়ায় সেই রাস্তায় হেঁটে ভারতের আর একটা রূপকথার জয়ের আশা? টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সেমিফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিসের বিরুদ্ধে ভারতের হারের পর দেশটির জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার একটি খবর প্রকাশ করেছে যার শুরুর কথাগুলো এমনই।
হ্যাঁ, আমি ১৯৯৩ সারের হিরো কাপ সেমিফাইনালে ইডেনে সেই দক্ষিণ আফ্রিকার শেষ ওভারে শচীন টেন্ডুলকারের বল করার কথা বলছি। সেই সময় রাঁচির কোন এক মাহেন্দ্র সিংহ ধোনি তো বারো বছরের কিশোর। কিন্তু সে দিনের ইডেন আর এ দিনের ওয়াংখেড়ের তফাৎ আকাশ-পাতাল। ইডেনে পিচ স্লো ছিল। স্লো বোলারকে মারা অনেক কঠিন ছিল। তা ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার যত দূর মনে পড়ছে ৭টা উইকেট পড়ে গিয়েছিল। টেলএন্ডাররা ব্যাট করছিল। আর এখানে ওয়াংখেড়ের পিচ পুরোপুরি ব্যাটিং-বন্ধু। ছোট বাউন্ডারি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাত্র ৩ উইকেট পড়েছিল। ক্রিজে জমে যাওয়া দু’জন স্পেশ্যালিস্ট ব্যাটসম্যান।
তাই শচীনের বিরুদ্ধে শেষ ওভারে ছয়ের জায়গায় দক্ষিণ আফ্রিকার তিনের বেশি তুলতে না পারা আর কোহালির শেষ ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জেতার বাকি ৮ রান আটকানোর স্বপ্ন দেখা— দু’টোর মধ্যে কোন তুলনাই আসে না।
বরং আমি বলব, কোহালিকে শেষ ওভারে আনার কোন মানেই নেই। এই বিশ্বকাপে ধোনির ক্যাপ্টেন্সিতে অনেক ভুল হয়েছে। এত দিন জিতছিল বলে সেগুলো সামনে আসেনি। এ দিন হেরে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেছে, সুতরাং এখন ওর সব ভুলের নিষ্ঠুর কাটাছেঁড়া চলবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, সীমিত ওভারের ফরম্যাটে ধোনি সেরা অধিনায়কের স্বীকৃতি পায়, ওকে ক্যাপ্টেন কুল বলার আসল কারণই তো এ রকম মহাম্যাচের অন্তিমে ভয়ঙ্কর চাপের সিচুয়েশনেও ওর বিন্দুমাত্র লড়াই না ছাড়া। সঠিক সিদ্ধান্তটা নিতে পারা।
কিন্তু বিশ্ব টি-টোয়েন্টি সেমিফাইনালের শেষ ওভার কোহালিকে দেওয়ার মধ্যে ধোনির ওই দু’টো ইউএসপিরই যেন চূড়ান্ত অভাব ফুটে বের হলো বৃহস্পতিবার রাতে।
যদি পার্টটাইম বোলার এনে ব্যাটসম্যানকে ভড়কে দেওয়াই ধোনির পরিকল্পনা ছিল, তা হলে রায়না নয় কেন? কোহালি এ দিন আগে প্রথম ডেলিভারিতে জমে যাওয়া চার্লসকে আউট করেছিল বলেই কি শেষ ওভারে ওকে আনা? আমি বলব, তা হলে ধোনি তুমি কোহালি যে ওভারে উইকেট পেয়েছিল, সেই সময় ওকে দিয়ে আর একটা ওভার করিয়ে নিতে পারতে।
তা ছাড়া, এ দিনের আগে কোহালি টি-টোয়েন্টিতে কবে শেষ বল করেছিল, তাও দু’ওভার, আমি তো এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। দেশের হয়ে তো বটেই, আইপিএলে রয়েল চ্যালেঞ্জার ব্যাঙ্গালুর হয়েও!
আসলে এ দিন ধোনির বোলারদের ওভারের হিসাব রাখায় ভুলভাল হয়েছে। সেটা কি নিজেরা ১৯২ তোলার পরেও ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের খানিকটা অপ্রত্যাশিত পাল্টা ঠ্যাঙানির ধাক্কায়? না হলে অশ্বিন কী করে একটা নয়, দু’টো ওভার কম করে? মানছি, মেরিন ড্রাইভের ধারের ওয়াংখেড়েতে শেষ মার্চের রাতের দিকে শিশির একটা ফ্যাক্টর। স্পিনারদের বল গ্রিপ করতে অসুবিধা হচ্ছিল। তা হলে উনিশতম ওভার ধোনি কেন জাদেজাকে আনল? নেহরা তো বটেই, এমনকি ওর প্রিয় হার্দিক পান্ডের কোটাও আগেভাগে শেষ করে দিয়ে বসল?
‘ধোনির প্রিয়’ বলতে গিয়ে আর একটা ব্যাপার লিখতে ইচ্ছে করছে। ধোনির এই এক অদ্ভুত অভ্যাস তৈরি হয়েছে শেষ কয়েক বছরে। টিমে এক-এক জনের উপর অগাধ আস্থা। আর সেই আস্থাটা যে টিমমেটের উপর, তার সবই ভাল ওর কাছে। নইলে এ দিন অশ্বিন দু’ওভার কম করে? আর পান্ডে পুরো কোটা করে? তবে যুবরাজের না থাকাটা ধোনির বোলিং-প্ল্যানে এ দিন একটা ধাক্কা ছিল তো বটেই। তা সত্ত্বেও বলব, হরভজনকে না খেলিয়ে এত বড় ম্যাচে বাড়তি ব্যাটসম্যান হিসেবে মনীষ পাণ্ডেকে খেলানোর সিদ্ধান্তটা ঠিক ছিল। তা ছাড়া যেখানে অশ্বিনই দু’ওভার কম করে, সেখানে হরভজন আর কী আস্থা পেত অধিনায়কের?
তা ছাড়া যে দিনটা আপনার নয়, সে দিন আপনার বিপক্ষে অদ্ভুত কিছু ব্যাপারও ঘটবে। এ দিন যেমন ক্যারিবিয়ানদের ফাইনালে ওঠানোর নায়ক লেন্ডল সিমন্স দু’-দু’বার আউট হল নো বলে। ডাগআউটে ফিরে যাওয়া থেকে তো বাঁচলই, দু’টো ফ্রি হিটও পেয়ে গেল। দিনটা টিম ইন্ডিয়ার ছিল না বলেই না, গোটা বিশ্বকাপ জুড়ে অবিশ্বাস্য ব্যাটিং পারফরম্যান্স দেখিয়েও কিনা কোহালির ওভারেই ভারতের বিরাট বিদায় ঘটে!
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা
বিডি-প্রতিদিন/০১ এপ্রিল, ২০১৬/মাহবুব