ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের যুদ্ধ এবার সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে গড়াতে চলেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানকে ‘আত্মসমর্পণ’ করার আহ্বান জানানোর পর যুক্তরাষ্ট্রের তরফে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপজুড়ে ব্যাপক সামরিক তৎপরতা চালানো হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন ঘাঁটিতে নতুন করে ৩০টি যুদ্ধবিমানসহ রণতরি ও ট্যাংকার বিমান মোতায়েন করা হয়েছে। এদিকে ইরানও পাল্টা প্রস্তুতি নিয়েছে। তাদের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ হামলায় জড়িত জর্ডান-ফ্রান্স-যুক্তরাজ্যকে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয়েছে, সমুচিত জবাব দেওয়ার জন্য ইরান সম্পূর্ণ প্রস্তুত। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে বলেছেন, ‘আমেরিকা তার চূড়ান্ত ধ্বংস ডেকে আনতে চলেছে।’ এদিকে মার্কিন সামরিক তৎপরতার বিরুদ্ধে সকর্তবার্তায় রাশিয়া বলেছে, ‘ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালালে তা বিশ্বকে পারমাণবিক মহাবিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেবে।’
এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য জড়িত থাকার বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছেন। এ লক্ষ্যে মঙ্গলবার রাতে তিনি তাঁর নিজস্ব জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে কথা বলেছেন। এ আলোচনা ওয়াশিংটনের মধ্যপ্রাচ্যে পরবর্তী পদক্ষেপগুলো নির্ধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। উত্তেজনার পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতাও অব্যাহত রয়েছে। কিছুটা সুর নরম করেছে ইসরায়েল। ইরানও সমঝোতার চেষ্টা করছে বলে বিভিন্ন সূত্রের বরাতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। দ্য টাইমস অব ইসরায়েলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন সামরিক বাহিনী ইসরায়েলকে সাহায্য করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। মার্কিন যুদ্ধবিমান, জ্বালানি ভরার বিমান ও বিমানবাহী রণতরি এরই মধ্যে এ অঞ্চলে পৌঁছেছে। খবরে বলা হয়, নেতানিয়াহু এ দিন ইসরায়েলের স্থানীয় সময় রাত ১টার দিকে ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনালাপ শেষ করেন। পরে তিনি জানান, গত সপ্তাহে ইরানের ওপর ইসরায়েলের আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে তিনি প্রায় প্রতিদিনই ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলছেন। এদিকে তিনজন মার্কিন কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, ওয়াশিংটন মধ্যপ্রাচ্যে আরও যুদ্ধবিমান মোতায়েন করছে এবং অন্যান্য যুদ্ধবিমান মোতায়েনের সময়সীমা বাড়িয়েছে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে প্রায় তিন ডজন জ্বালানিবাহী বিমান পাঠিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে ৪০ হাজারের বেশি সেনা উচ্চ সতর্কতায় রেখেছে। তাদের বেশির ভাগই সৌদি আরব, জর্ডান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থান করছে। দুটি বিমানবাহী মার্কিন রণতরি ওই অঞ্চলের দিকে যাচ্ছে। দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইসরায়েলের সঙ্গে যৌথভাবে ইরানের ওপর হামলায় অংশ নেয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে পাল্টা হামলা চালাতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে ইরান।
মার্কিন কর্মকর্তারা নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, ইরান এরই মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম প্রস্তুত রেখেছে, যা প্রয়োজনে বাহরাইন, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে মার্কিন সামরিক স্থাপনায় আঘাত হানতে ব্যবহৃত হবে। অন্যদিকে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমাদের ওপর হামলা চালিয়ে কেউ কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারবে না। ইরানি জনগণের ওপর কোনো ইচ্ছা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।’ তিনি ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে ফোনালাপে জানান, যদি যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে, তবে তার দায়ভার বহন করতে হবে ইসরায়েল ও তার প্রধান মিত্রদের। পাশাপাশি ইরান ঘোষণা দিয়েছে, ইসরায়েলের হয়ে যুক্তরাষ্ট্র যদি হামলা শুরু করে, তাহলে ইরাকে থাকা মার্কিন ঘাঁটিগুলোই হবে প্রথম টার্গেট। পাশাপাশি যারা ইসরায়েলকে সহায়তা করবে, সেসব আরব দেশের ঘাঁটিতেও হামলা চালানো হবে।
বিবিসি ও রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েল ও ইরানের যুদ্ধের মধ্যে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ব্যাপক সামরিক তৎপরতা শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত তিন দিনে ৩০টির বেশি মার্কিন সামরিক বিমান যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউরোপের বিভিন্ন ঘাঁটিতে পাঠানো হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা একে আসন্ন কোনো বড় সংঘাতের প্রস্তুতি হিসেবে দেখছেন। ফ্লাইট ট্র্যাকিং ডেটা অনুযায়ী, তিন দিনে যেসব বিমান ইউরোপে পাঠানো হয়েছে, তার সবই মার্কিন বিমানবাহিনীর ট্যাংকার বিমান। এ বিমানগুলো যুদ্ধবিমান ও বোমারু বিমানে মাঝ আকাশে জ্বালানি ভরার কাজে ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে অন্তত সাতটি কেসি-১৩৫ মডেলের ট্যাংকার বিমান স্পেন, স্কটল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যের মার্কিন বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করেছে। একই সময়ে মার্কিন নৌবাহিনীর বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস নিমিৎজকে দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে যাত্রার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইউএসএস নিমিৎজের সঙ্গে বহু যুদ্ধবিমান ও একাধিক গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার রয়েছে। আরেক সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ঘাঁটিতে এফ-১৬, এফ-২২ ও এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানও পাঠিয়েছে। ইউরোপে পাঠানো ট্যাংকার বিমানগুলো এসব যুদ্ধবিমানকে জ্বালানি সহায়তা দেবে। যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট (রুসি) থিংকট্যাংকের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক জাস্টিন ব্রঙ্ক বলেন, ‘এ তৎপরতা জোরালোভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্র আগামী সপ্তাহগুলোতে এ অঞ্চলে তীব্র যুদ্ধপরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।’ মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স সমাজমাধ্যমে লিখেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করতে আরও পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।’
এএফপির আরেক খবরে বলা হয়, গতকাল (বুধবার) ভোরে রয়্যাল এয়ারফোর্স লেকেনহিথ ঘাঁটি থেকে অন্তত একটি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান আকাশে উঠেছে। এ ছাড়া ইরানের মাটির গভীরে তৈরি স্থাপনায় হামলা করতে পারে যে বি টু স্পিরিট বোম্বার বিমান, সেগুলোও ভারত মহাসাগরে ইরান থেকে ৪ হাজার কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে একটি ঘাঁটিতে রাখা হয়েছে। এই সঙ্গে তিন দিনে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ৩০টি মিলিটারি বিমান যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্পেন, স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের বিভিন্ন ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
রাশিয়ার সতর্কবার্তা : ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলকে সামরিকভাবে সহায়তা না করতে যুক্তরাষ্ট্রকে কড়া সতর্কবার্তা দিয়েছে রাশিয়া। দেশটির উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রায়েবকোভ গতকাল বলেন, ইসরায়েলকে যদি যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সহায়তা করে তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে।
এ ছাড়া আলাদাভাবে রুশ পররাষ্ট্র গোয়েন্দা সার্ভিসের প্রধান সের্গেই নারস্কিন জানিয়েছেন, ইরান-ইসরায়েলের যুদ্ধ সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে আছে।
আত্মসমর্পণ চাইলেন ট্রাম্প : ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধ গতকাল পঞ্চম দিনে গড়িয়েছে। এর মধ্যেই ইরানের ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ’ দাবি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। পাশাপাশি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে সাদ্দাম হোসেনের মতো পরিণতির হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইসরায়েল। মঙ্গলবার ডোনাল্ড ট্রাম্প জানান, যুক্তরাষ্ট্রের ধৈর্য কমে আসছে, তবে আপাতত ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে হত্যার কোনো উদ্দেশ্য তাদের নেই। তিনি ইরানের প্রতি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। খামেনি ইরানের কোথায় আছেন সে ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তথ্য আছে বলেও জানান ট্রাম্প। প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে তিনি বলেন, খামেনি ‘আপাতত’ নিরাপদ আছেন।
ইরানের হুঁশিয়ারি : ইসরায়েলের সামরিক হামলায় যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি অংশ নিলে ইরান যে সমুচিত জবাব দেবে, ওয়াশিংটনকে তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘে তেহরানের রাষ্ট্রদূত আলি বাহরেনি। রয়টার্স জানায়, গতকাল তিনি জেনেভায় সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। বাহরেনি জানান, ‘ইরান একটি রেডলাইন ঠিক করেছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি সেটি অতিক্রম করে তাহলে আমরা জবাব দেব।’
খামেনি বললেন ‘যুদ্ধ শুরু’ : ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি সমাজমাধ্যম এক্সে দেওয়া পোস্টে ঘোষণা করেছেন, ‘হায়দারের নামে যুদ্ধ শুরু হলো।’ বিবিসি জানায়, গতকাল তিনি টিভিতে জাতির উদ্দেশে একটি বিবৃতি দিয়ে বলেন, ‘আমার দেশ মার্কিন প্রেসিডেন্টের কোনো আহ্বান মেনে নেবে না। যুদ্ধ কিংবা শান্তি কোনোটিই ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। বুদ্ধিমান মানুষ যারা ইরানকে জানে, ইরানি জাতিকে জানে এবং এর ইতিহাস জানে তারা কখনো এ দেশের বিরুদ্ধে হুমকির ভাষায় কথা বলে না। কারণ ইরানি জাতি আত্মসমর্পণ করবে না। মার্কিনিদের জানা উচিত কোনোরকম মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ তাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি ও ধ্বংস ডেকে আনবে।’ এদিকে মেহের নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে, তেহরান ঘোষণা করেছে ইরানে হামলায় জড়িত জর্ডান-ফ্রান্স-যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রকে কঠোর পরিণতি ভোগ করতে হবে। হামলায় জড়িত দেশগুলোকে পাল্টা জবাব দেওয়া হতে পারে।
ইসরায়েলে মার্কিন দূতাবাস বন্ধ : ইসরায়েলে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস বন্ধ ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। গতকাল কাতারভিত্তিক আলজাজিরার প্রতিবেদনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বরাত দিয়ে বলা হয়, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান সংঘাত এবং ইসরায়েলের হোম ফ্রন্ট কমান্ডের নির্দেশনা মেনে জেরুজালেমে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস এবং তেল আবিবের কনস্যুলার বিভাগ আজ (বুধবার) থেকে আগামী শুক্রবার পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। বিবৃতিতে মার্কিন দূতাবাস জানায়, দূতাবাসের সব মার্কিন কর্মচারী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তাদের বাসস্থান বা এর আশপাশে আশ্রয় নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ইসরায়েলে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইরান : দখলদার ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইরান। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এএফপি এ কথা জানিয়েছে। গতকাল বাংলাদেশ সময় রাত পৌনে ১১টার দিকে মিসাইল ছোড়ে দেশটি।
ইরানের দাবি, ‘ফাত্তাহ’ নামের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে সফলভাবে প্রবেশ করেছে।