জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় ঐকমত্য হয়নি রাজনৈতিক দলগুলোর। তাই বিষয়টি নিয়ে আজ ফের আলোচনা হবে। এদিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও ক্ষমতা নিয়ে আলোচনায়ও একমতে পৌঁছাতে পারেনি দলগুলো। আজকের বৈঠকে এ নিয়েও আলোচনা হবে বলে জানিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। গতকাল ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা শেষে এসব তথ্য জানা যায়। এ সময় কমিশনের সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে গতকালের আলোচনায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। আজ সকাল ১১টায় আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসবে কমিশন। গতকালের বৈঠক শেষে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা দুটি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সাংবিধানিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা রাজনৈতিক দলগুলো অনুভব করে। দু-একটি দলের মধ্যে এ ব্যাপারে নীতিগত মতপার্থক্য থাকলেও একটি সাংবিধানিক ব্যবস্থার বিষয়ে সবাই মত দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সংবিধান সংস্কার কমিশন এবং নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের দুটি প্রস্তাব রয়েছে। এ ছাড়া ক্ষমতার ভারসাম্যের জন্য রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। এসব বিষয়েও আলোচনা অব্যাহত থাকবে। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের ফাংশনে বলা আছে তাদের দায়িত্ব কী হবে। তবে এ কাউন্সিল যখন প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ হবে না, পার্লামেন্ট ডিজলভব (ভেঙে দেওয়া হবে) তখন পর্যন্ত এটা বহাল থাকবে। আবার যখন পার্লামেন্ট না থাকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ হয়ে যায় তখন মাত্র পাঁচজনের একটা কমিটি হয় যেখানে নেতৃত্বে থাকেন প্রধান উপদেষ্টা, আরও দুজন উপদেষ্টা, চিফ জাস্টিস ও প্রেসিডেন্ট। দায়িত্ব একই থাকবে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী না আসা পর্যন্ত। এরকম একটি কর্তৃপক্ষ যেটা প্রস্তাব করা হয়েছে, তাদের যে দায়িত্ব এটা এখন নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক বিভিন্ন আইনের মাধ্যমে হয়। সাংবিধানিক প্রবিশনের মধ্য দিয়ে হয়। জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) প্রশ্নে ঐকমত্য না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, এনসিসি গঠন প্রক্রিয়ায় এনসিপির পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। কারণ বিগত দিনে নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, দুদক ও মানবাধিকার কমিশনসহ বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান দলীয়করণ করা হয়েছে। বিতর্কিত করা হয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছে। একতরফা নির্বাচনের বিষয়ে কমিশন সব সময় সাফাই গেয়ে গেছে। আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, যারা ক্ষমতায় যেতে চান, তারা সংস্কার চান না। বিশেষ করে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি কমিশনের নিয়োগ তারা আগের মতো নির্বাহী বিভাগের হাতে রাখতে চান। আমরা মনে করি, এ পদ্ধতিতে নিয়োগের কারণে অনেক সময় দলীয় ও আঞ্চলিকতা কাজ করে। এতে সঠিক ব্যক্তি বাছাই করা হয় না।
ওয়াকআউট সিপিবি ও গণফোরামের : জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে জামায়াত নেতাদের বেশি কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে দাবি করে অধিবেশন থেকে ওয়াকআউট করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও গণফোরাম। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার আবারও তাদের সম্মেলন কক্ষে নিয়ে যান। গতকাল ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় এ ঘটনা ঘটে। এর আগে মঙ্গলবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে অনুপস্থিত ছিল জামায়াতে ইসলামী। লন্ডনে যৌথ বিবৃতির প্রতিবাদস্বরূপ ওই দিন আলোচনা বয়কট করে দলটি। প্রধান উপদেষ্টার ফোনে গতকাল ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে জামায়াত যোগ দিয়েছে বলে জানান দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। সংশ্লিষ্টরা জানান, গতকাল জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের বক্তব্য শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বক্তব্য দেওয়া শুরু করলে প্রথমে গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান হইচই করে সংলাপস্থল থেকে বের হয়ে যান। এ সময় তিনি বলেন, এখানে কীসের সংলাপ হচ্ছে, কার সঙ্গে সংলাপ করব। তারা যা ইচ্ছা তাই করছে। এরপর বের হন সিপিবি সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্সসহ দুজন। মিজানুর রহমান অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। তখন তাকে জড়িয়ে ধরে সংলাপস্থলে যাওয়ার অনুরোধ করেন ১২-দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম। সে সময় গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন রুহিন হোসেন প্রিন্স। পরে কথা বলেন সেলিম। রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, জামায়াতের তিনজন কথা বলেছেন। আমাদের একজন কথা বলতে গেলে তাকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। আমরা প্রতিবাদ করেছি। বৈঠক শেষে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, আলোচনার টেবিলে তর্ক-বিতর্ক, মতভেদ থাকতেই পারে। এসব স্বাভাবিক। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বৈঠক শেষে বলেন, আমরা আগের দিনের বৈঠকে ছিলাম না। তাই আলোচ্য বিষয়গুলোর ওপর কথা বলায় একটু বেশি সময় লাগছিল। এ নিয়ে তারা রাগ করেন।
বয়কটের পর জামায়াতের যোগ- যৌথ বিবৃতিতে আপত্তি : লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বৈঠকে নির্বাচনের সময় নির্ধারণে জামায়াতে ইসলামীর আপত্তি নেই, তাদের আপত্তি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের যৌথ বিবৃতিতে। গতকাল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় অংশ নেওয়ার বিরতিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা জানান জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপে মঙ্গলবারের আলোচনা বয়কট করে জামায়াত। লন্ডনে যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে জামায়াতকে ‘ইগনোর’ করা হয়েছে- এমন দাবি তুলে প্রতিবাদস্বরূপ ওই দিন দলটি সংলাপে যায়নি। তবে বুধবার (গতকাল) আলোচনায় অংশ নেয় জামায়াত। নেতৃত্ব দেন ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি মঙ্গলবারের বৈঠকে জামায়াতের অনুপস্থিতির বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন সফরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠককে আমরা ওয়েলকাম জানিয়েছি। ওখানে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে তিনি যে কথা বলেছেন, তাতেও আমাদের তেমন কোনো আপত্তি নেই। আমাদের প্রস্তাবনায় ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের সময়সীমা ছিল। ডিসেম্বর হলেও আমাদের প্রস্তাবের ভিতর থাকত, ফেব্রুয়ারিতেও আছে, এপ্রিলে হলেও থাকত।’ জামায়াতের নায়েবে আমির বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার পর নির্বাচনের তারিখ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পরিবর্তন হলে সমস্যা ছিল না। বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল। তাদের দাবি থাকতে পারে। তবে এটা ভালো হতো যদি প্রধান উপদেষ্টা দেশে ফিরে টেলিভিশনে ঘোষণার মাধ্যমে তারিখটা পরিবর্তন করতেন। সেটা তিনি করেননি। ডা. তাহের বলেন, ‘আমরা খুব বিস্মিত হয়ে দেখলাম একটি দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তারা যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন। এ দেশে ১০০টিরও বেশি রাজনৈতিক দল আছে। তাহলে তো এমন কালচার তৈরি হবে, উনি (প্রধান উপদেষ্টা) যাদের সঙ্গেই কথা বলবেন, জয়েন্ট স্টেটমেন্ট দিতে হবে। এ যৌথ বিবৃতিতে আমাদের আপত্তি। এতে অনেক রাজনৈতিক দলই বিব্রত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা নিরপেক্ষতা হারিয়েছেন অভিযোগ করে জামায়াতের নায়েবে আমির বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশন এখন ইফ, যদিতে আছে, কিন্তুতে যাবে কি না আল্লাহ জানেন। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ফোন করে নিরপেক্ষ থাকার আশ্বস্ত করায় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে যোগ দিয়েছে জামায়াত।