ফেনী সদর, ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, দাগনভূঞা ও সোনাগাজী উপজেলায় বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেল, বন্যার পানি কমে আসায় কিছু কিছু এলাকায় বন্যাদুর্গতরা আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। আবার কোথায় দেখা যাচ্ছে বন্যার পানি একটু কমে যাওয়ায় নিজ বাড়ি থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে।
বন্যায় প্রায় ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি দেখা দিয়েছে সুপেয় পানি ও খাবারের চরম অভাব। বিপৎসীমার নিচ দিয়ে জেলার মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে। তবে এখনও পানিবন্দি রয়েছেন জেলার বিভিন্ন উপজেলার লাখ লাখ মানুষ।
ফেনী পৌর শহরের দুই থেকে তিনটি সড়কে ও বাসাবাড়িতে পানি কমলেও এখনো শহরের অনেক সড়ক ও বিভিন্ন ভবনের পানি পুরোপুরি সরেনি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যায় জেলার ছয়টি উপজেলার অন্তত দুই লাখ মানুষ বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছিল। বুধবার সকালে সদর উপজেলার কালিদহ ইউনিয়নের আলোকদিয়া ও ভালুকিয়া এলাকায় দেখা যায়, দলে দলে নারী-পুরুষ আশ্রয়কেন্দ্র থেকে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরছেন।
ছাগলনাইয়া উপজেলার ঘোপাল ইউনিয়নের বন্যাদুর্গত সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ঘরে বুক সমান পানি হওয়ার পর ঘরের ছাদে উঠে যায়। বৃষ্টির মধ্যেই পরিবার নিয়ে ৪ দিন ৪ রাত কাটাতে হয়েছে। পানি একটু কমায় বারাইয়ারহাট গিয়ে মঙ্গলবার মোবাইলে চার্জ দিয়েছে। তার ঘরে এখনও পানি রয়েছে। উঠানে বুক সমান পানি। বন্যার পানি তার ঘরের ছাদের একফুট নিচ পর্যন্ত ছিলো। ঘরে গিয়ে যে কিছু রান্না করে খাব সে পরিস্থিতি এখন নেই। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আমার মতো আমাদের গ্রামের অনেকেরই একই অবস্থা। এমন অবস্থায় সহযোগিতা ছাড়া টিকে থাকা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
ফুলগাজীর বাজারের পাশেই বাড়ি গণমাধ্যম কর্মী সজিব জামালের বাড়ি। তিনি জানান, সন্ধ্যার দিকে পানি প্রবেশ করেছে শুনেছি আমলে নিইনি। রাতে দেখি পানি ঘরে ঢুকে পড়েছে। তখনও ঘরেই ছিলাম। কারণ বন্যার পানি আমাদের ঘরে কখনও উঠে না। মনে করেছিলাম আর উঠবে না তাই ঘুমিয়ে পড়ি। গভীর রাতে দেখি আমার থাটে পানি। কোন রকম পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ছাদে উঠে যাই। তিনদিন তিনরাত ছাদে ছিলাম। খাবার পানি ও খাদ্যের অভাবে অনেক কষ্ট করেছি। শুধু একবার স্বেচ্ছাসেবকরা মুড়ি, চিড়াসহ শুকনো খাবার দিয়েছে। এই সামন্য খাবের ৩ দিন ৩ রাত পার করেছি। মঙ্গলবার বিকেলে পানি একটু কমার পর নৌকার সাহায্যে বাজারে গিয়ে কিছু শুকনো খাবার সংগ্রহ করি ও মোবাইলে চার্জ দিয়। তবে এখনও বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। এখনও আশপাশের প্রায় এলাকা তলিয়ে আছে। তিনি জানান, তার গ্রামের আশপাশে এই পর্যন্ত ৪ জন মৃত্যুবরণ করেছে। পুরো উপজেলায় কতজন মৃত্যুবরণ করেছে এই মুহূর্তে জানা সম্ভব হয়নি।
এদিকে বন্যাদুর্গতরা তাদের নিজ নিজ ঘরবাড়িতে ফিরলেও সেখানে দেখা যায় মহাদুর্ভোগের চিত্র। যেসব ঘরবাড়ি থেকে বন্যার পানি সরে গেছে, সেসব ঘরবাড়ি ময়লা আবর্জনার স্তূপে পরিণত হয়েছে। ঘরে ফেরা পরিবারের সদস্যদের এসব আবর্জনার স্তূপ পরিষ্কার করার কাজে ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা গেল। ঘরে ফেরা পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আমরা এতদিন আশ্রয়কেন্দ্রে মহাদুর্ভোগে দিন পার করেছি। পুরোপুরি ভাবে আমাদের বসতঘর বসবাসের উপযোগী করতে আরো দুই একদিন সময় লাগবে।
বাজারেও নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এই অবস্থায় কিভাবে দিন পার করবেন- এই নিয়ে তারা বেশ চিন্তিত। এ সময় তারা সমন্বিত ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম নিশ্চিত করার জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে জোর দাবি জানান। সদর উপজেলার কালিদহ ইউনিয়নের আলোকদিয়া ও ভালুকিয়া গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, এখনো গ্রামীণ সড়কের ওপর দিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এসব এলাকায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। টিউবওয়েলগুলো নষ্ট হওয়ার কারণে সুপেয় পানির সংকট আরো তীব্রতর হয়েছে। বন্যায় অনেকের খেতের ফসল নষ্ট হয়েছে, বন্যার পানিতে ভেসে গেছে পুকুর ও ঘেরের মাছ। এছাড়াও পানিতে পোল্ট্রি মুরগি ও গবাদি পশুও ভেসে গেছে।
জেলার ভারপ্রাপ্ত ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সুলতানা নাসরিন কান্তা জানান, ফেনী জেলার ছয়টি উপজেলার বাসিন্দারা বন্যা কবলিত। এ সময় জেলার আনুমানিক ২ লাখ পানিবন্দি মানুষ বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করেছেন। ধীরে ধীরে এইসব আশ্রয়কেন্দ্র থেকে কিছু কিছু লোকজন তাদের ঘরবাড়িতে ফিরে যাচ্ছেন। বন্যা পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে আরো দুই একদিন সময় লাগবে।
বিডি প্রতিদিন/এএ