৯ আগস্ট শুক্রবার বাড়ি গিয়েছিলাম, দেশের সহিংস পরিস্থিতির কারণে গত কয়েক সপ্তাহ যেতে পারিনি। এমনিতে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই যাই। রাজধানীর সন্নিকটে হওয়ায় আমাদের এলাকায় (বিক্রমপুরের শ্রীনগর) যাতায়াত খুব সহজ এখন। বাসে গেলে ৪০-৪৫ মিনিট, আর নিজস্ব গাড়িতে গেলে সর্বোচ্চ ২৫ মিনিট। বলা নিষ্প্রয়োজন, ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক এক্সপ্রেসওয়েতে রূপান্তরের ফলে এই সুবিধার সৃষ্টি। আমার গ্রামে যাওয়ার দুটি উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমত, এলাকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক এই পটপরিবর্তনে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া অনুধাবন। ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক কর্মী, শিক্ষক, ছাত্র, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ অনেকের সঙ্গে কথাবার্তা হলো। তবে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে সদ্যবিদায়ী আওয়ামী লীগের কোনো নেতা-কর্মীকে পেলাম না। অবশ্য আমাদের গ্রামের মসজিদে দেখা হয়েছিল চেয়ারম্যান হামিদুল্লাহ খান মুনের সঙ্গে। অত্যন্ত ভদ্র ও মার্জিত এ তরুণের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার কিংবা দলীয় প্রভাব বিস্তার করে কারও অনিষ্ট করার অভিযোগ নেই। ফলে সে নিরুপদ্রবেই নিজ বাড়িতে অবস্থান করছে। তারপরও দেশে স্থিতিশীল পরিস্থিতি না আসা পর্যন্ত ওকে সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরা করতে পরামর্শ দিলাম। ওকে বললাম, তোর দলে যারা তোর প্রতিপক্ষ, তারা এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে শত্রুতা উদ্ধার করতে পারে।
সাধারণ মানুষ খুব খুশি। তাদের বক্তব্য আমরা একটি দুঃসময় থেকে পরিত্রাণ পেয়েছি। বিগত সরকারের সময় তারা স্বস্তিতে ছিল না। সব জায়গায় ছিল শাসক দলের রাজত্ব। হাট-বাজারের ইজারা, উপজেলা পরিষদের টেন্ডার, স্কুল কিংবা মসজিদের পরিচালনা কমিটি গঠন, সবখানে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের দোর্দন্ড প্রতাপে সবাই ছিল তটস্থ। কথা বলার উপায় ছিল না। তার ওপর কারণে-অকারণে চাঁদাবাজি তো ছিলই। একজন বললেন, গত পনেরো বছর ১৫ আগস্ট উপলক্ষে বাধ্যতামূলক চাঁদা দিতে হয়েছে। তাও আমার ইচ্ছা অনুযায়ী নয়, দিতে হয়েছে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী। আর মাত্র কদিন বাকি ১৫ আগস্টের, এবার এখনো কেউ আসেনি। এসব চাঁদাবাজি চলেছে নীরবে। কারও কাছে প্রকাশ করার উপায় ছিল না। ভদ্রলোক বললেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে কে না ভালোবাসে? তাঁকে আমিও শ্রদ্ধা করি। তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। কিন্তু তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী পালনের জন্য জবরদস্তিমূলক চাঁদাবাজি করতে হবে কেন? এতে কি তাঁর আত্মা শান্তি পেয়েছে, নাকি অভিশাপ দিয়েছে? আরেকজন বললেন, যা-ই বলেন দাদা, আমরা রাজনৈতিক হয়রানিমুক্ত পরিবেশে থাকতে চাই। আওয়ামী লীগের দুঃশাসন থেকে রেহাই পেয়েছি বলে অন্য কোনো দলের খপ্পরে পড়তে চাই না। জিজ্ঞাসা করলাম, ওরকম কোনো আলামত পাচ্ছেন নাকি? একটু এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললেন, কী বলব ভাই, এখনই যে হাবভাব দেখতে পাচ্ছি, তাতে ভয় হয়, আমরা আবার ‘ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে’ পড়তে যাচ্ছি কি না। তাই আমরা চাই এ অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে রাজনীতির সব জঞ্জাল সাফ করে দিয়ে যাক।
দেখা হলো ¯ন্ডেœহভাজন বিএনপি নেতা শ্রীনগর কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক জি এস সিদ্দিকুর রহমান মিলনের সঙ্গে। সে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, লিডার, আজ আমরা স্বাধীন। দেশ দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীন হয়েছে। ওকে বললাম, প্রথমত আমি আর এখন কোনো লিডার না, সাধারণ একজন নাগরিক। আর আমরা এবার কোনো স্বাধীনতা পাইনি, বলতে পার একটি শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়েছি। যেমনটি পেয়েছিলাম ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর। আমরা স্বাধীন হয়েছি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে। এবারের শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং তৎ-পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনার দেশত্যাগ নজিরবিহীন ঐতিহাসিক ঘটনা বটে, তবে তা কোনোভাবেই আমাদের মহান স্বাধীনতার সঙ্গে তুলনীয় নয়। মাথা নেড়ে সমর্থন জানিয়ে সে বলল, তবে ভাই, আমরা এখন প্রাণ খুলে কথা বলতে পারছি, নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারছি, এটা কি স্বাধীনতার চেয়ে কম? বললাম, এটা ঠিক, ১৯৭১-এ অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা গত সাড়ে পনেরো বছর একটি দলের সিন্দুকবন্দি ছিল। সে সিন্দুকের ঢাকনা খুলে গেছে, মানুষ হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। মিলনকে বললাম, দেখ, সবেমাত্র একটি গণঅভ্যুত্থান শেষ হয়েছে। এত বড় একটি ওলট-পালট, সবখানে বিশৃঙ্খলা, থানায়-রাস্তায় পুলিশ নেই, শিক্ষার্থীরা ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করছে, এমন সময়ে তোমাদের দলের সমাবেশ থেকে ‘দ্রুততম সময়ে নির্বাচন’ দাবি করা কি ঠিক হয়েছে? যেখানে সদ্য গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাংবিধানিক ভিত্তি কী সেটাই জানা যায়নি, সেখানে সে সরকারের কাছে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন দাবি করা কতটা যৌক্তিক কাজ হয়েছে? তা না করে তোমাদের নেতারা যদি কর্মীদের নির্দেশ দিতেন, সামাজিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার-প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে, তাহলে তা মানুষের কাছে প্রশংসিত হতো। কিন্তু তোমরা কি জানো, তোমাদের ওই তড়িঘড়ি সমাবেশ সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে? তারা বলছে, তোমাদের দল ও শীর্ষনেতা রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে অস্থির হয়ে উঠেছেন। নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তিতে শুকরিয়া আদায় এবং আন্দোলনে শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া মাহফিল না করে, সরকার গঠিত হওয়ার আগেই তার কাছে নির্বাচনের দাবি জানানো আর যা-ই বলা যাক, সুবিবেচনাপ্রসূত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলা যাবে না।
আমার কথা শুনে মিলন বলল, কিন্তু ভাই, একটি স্বৈরশাসনের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে এমন দাবি জানানোটা কি অন্যায়? বললাম, অন্যায় নয়। তোমার ছেলে তোমার কাছে প্রয়োজনে টাকা বা একটি কিছু চাইতেই পারে, সে অধিকার তার রয়েছে। কিন্তু সেই মুহূর্তে তোমার আর্থিক সংগতির কথাও তাকে বিবেচনা করতে হবে। তা ছাড়া তোমাদের দলের নেতা, পাতি-নেতাদের কথাবার্তা শুনলে মনে হয়, তারা এই আন্দোলন সফল করেছে। কিন্তু সত্যি করে বল তো, এই আন্দোলনে তোমাদের ভূমিকা কতটুকু? পনেরো বছর রাজপথে তোমরা একজন সাধারণ মানুষকেও নামাতে পারনি। এবার শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবির আন্দোলনে সরকারের দমননীতি ও হত্যাযজ্ঞ জনগণকে সংক্ষুব্ধ করে তুলেছিল, তারা রাস্তায় নেমেছে। যার ফলে শেখ হাসিনার বিদায় সম্ভব হয়েছে। এ সময় পাশে দাঁড়ানো এক যুবক ফোঁড়ন কেটে বলল, ওনাদের ডাকে জনগণ রাস্তায় নামবে কি, উনারাই তো আন্দোলনের ডাক দিয়ে রাস্তা থেকে বাড়িতে গিয়ে বসে থেকেছেন। যুবক চলে যাওয়ার পর মিলনকে বললাম, শুনলে তো পাবলিক রিয়েকশন। নেতাদের বলো কয়েক বছর ধৈর্য ধরতে। সে বলল, আমার আওয়াজ সে পর্যন্ত পৌঁছবে না। আপনি আপনার কলমের মাধ্যমে সহজেই সেটা করতে পারবেন।
ভাবছিলাম অতি-উৎসাহীদের কথা। একটি সরকার স্বাভাবিক কিংবা অস্বাভাবিক উভয় পথেই ক্ষমতাচ্যুত হতে পারে। জনগণের মনে সে সরকারের প্রধানমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রী-নেতাদের ওপর ক্ষোভও থাকতে পারে। কিন্তু সে ক্ষোভের আগুনে রাষ্ট্রীয় সম্পদ পুড়ে ছারখার হবে কেন? শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর ঊচ্ছৃঙ্খল জনতার অবাধে গণভবন, সংসদ ভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালেয় প্রবেশ এবং নজিরবিহীন লুটপাট কোনো বোধশক্তি-সম্পন্ন মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। ফেসবুকে দেখলাম কেউ কেউ লিখেছেন, ষোলো বছরের লাখ লাখ কোটি টাকা লুটপাট সহ্য করেছেন, ৫ তারিখে সামান্য কিছু জিনিসপত্র নিয়ে গেছে মানুষ, তা কেন সহ্য হয় না? প্রশ্ন টাকার পরিমাণের নয়। প্রশ্ন জাতীয় মর্যাদার। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জাতীয় সংসদ ভবন এবং গণভবন কারও পৈতৃক বা ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি। হ্যাঁ, কেউ কেউ তা পৈতৃক সম্পত্তির মতো ব্যবহার করতে পারে। সেটা ব্যক্তির অপরাধ, সম্পত্তির নয়। সেজন্য ওই ব্যক্তি জবাবদিহি তথা বিচারের মুখোমুখি হবে। কিন্তু এসব স্থাপনার মর্যাদা রক্ষা করা তো আমাদের দায়িত্ব। টেলিভিশন সংবাদের ভিডিওচিত্রে লুণ্ঠনের দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছি! যে ছেলেটি সংসদ ভবনের অধিবেশন ফ্লোরে এমপিদের চেয়ারে বসে আরেক চেয়ারে পা তুলে দিয়ে সিগারেট ফুঁকছিল, সে কি বোঝে সংসদ ভবনের গুরুত্ব? যে ছেলেটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সোফায় বসে পা নাচিয়েছে, সে কি জানে এ কার্যালয়ে কিছু দিন পরে আরেকজন সম্মানিত ব্যক্তি বসবেন? আর এই তিনটি ভবনে যথেচ্ছ ভাঙচুর, লুটপাট দেখে মনে হয়নি ওরা কেউ শিক্ষার্থী কিংবা বোধশক্তি-সম্পন্ন মানুষ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা স্পষ্টভাবে এসব ঘটনার নিন্দা করেছেন।
গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে দেখলাম, কেউ কেউ কোটা সংস্কার আন্দোলন সূত্রে সৃষ্ট ছাত্র-গণআন্দোলনকে ‘আরেক মুক্তিযুদ্ধ’ এবং ৫ আগস্টকে ‘দ্বিতীয় বিজয় দিবস’ হিসেবে অভিহিত করছেন। জাতি হিসেবে আমরা অত্যন্ত আবেগপ্রবণ সন্দেহ নেই। বেশির ভাগ সময় আমাদের আবেগ এতটাই প্রবল হয়ে ওঠে, বিবেক কাজ করে না। না হলে যারা এসব বলছেন, তারা ভেবে দেখতেন মুক্তিযুদ্ধ আর বিজয় দিবসের মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের কথা। এ পর্যন্ত আমাদের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ, আর সবচেয়ে গর্বের অর্জন স্বাধীনতা। আর সে স্বাধীনতা বাস্তব রূপলাভ করেছিল নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। যেজন্য ওই দিনটিকে আমরা বিজয় দিবস হিসেবে পালন করি। এখন ভিন্নরকম একটি পরিস্থিতিতে একটি রক্তাক্ত আন্দোলনের সফলতাকে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। সচেতন ব্যক্তিদের জিজ্ঞাস্য, এর মধ্যে তরুণদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং বিজয় অর্জনের মাহাত্ম্যকে ছোট করার কোনো অপকৌশল নেই তো? একটি কথা মনে রাখা দরকার, একটি জাতির জীবনে মুক্তি একাধিকবার আসতে পারে। কিন্তু স্বাধীনতা আসে একবারই, বারবার নয়। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি ১৯৭১ সালে। এরপর আমরা নানা সময়ে নানা ধরনের দুঃশাসন থেকে মুক্তি লাভ করেছি। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর আমরা নয় বছরের স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম এরশাদের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে। এবার তেমনি আরেকটি শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছি ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে। এ দুটি দিবস অবশ্যই স্মরণীয় এবং এ অর্জনের জন্য যাঁরা জীবন দিয়েছেন, তাঁরাও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সুতরাং সাম্প্রতিক আন্দোলনকে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ এবং ৫ আগস্টকে ‘দ্বিতীয় বিজয় দিবস’ বলা সুবিবেচনা প্রসূত বলে মনে হয় না। বরং আমরা এ দিনটিকে ‘গণতন্ত্রের মুক্তি দিবস’ হিসেবে পালন করতে পারি। আর সেটাই হবে যুক্তিযুক্ত।
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক