এ লেখা যখন লিখছি তখন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া হাসপাতালে। নানা জটিল রোগে ভুগছেন তিনি। বুধবার দিবাগত গভীর রাতে তাঁকে নেওয়া হয় এভারকেয়ার হাসপাতালে। সাড়ে ১৬ বছর সরকারের আক্রোশের শিকার ছিলেন বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই পাওয়া এই নেত্রী। কারাগারে দেশনেত্রীকে বিনা চিকিৎসায় রাখা হয়েছে। তিলে তিলে ঠেলে দেওয়া হয়েছে সংকটাপন্ন অবস্থার দিকে। এমনকি স্লো-পয়জন প্রয়োগ করে মারার চেষ্টা চলেছে এমন অভিযোগও করা হয়েছে দায়িত্বশীল মহল থেকে। চিকিৎসকরা তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার পরামর্শ দিলেও আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে অনুমতি পাওয়া যায়নি। গণ অভ্যুত্থানে সে দুর্দিনের অবসান ঘটেছে। অশেষ কৃতজ্ঞতা আমাদের ছাত্রসমাজের প্রতি। দেশনেত্রীর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে যুক্তরাজ্যে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। তবে বিমানে উঠতে হলে নেগেটিভ চাপ সহ্য করার মতো সুস্থতা থাকতে হয়। বিমান ল্যান্ড করার সময় চাপ সহ্য করার শারীরিক সুস্থতাও জরুরি। দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে একা ফেলে রাখা হয় তাঁকে। এমনকি গৃহবন্দি থাকার সময়ও চলেছে পরোক্ষভাবে নির্দয় আচরণ। সংকটজনক অবস্থায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে তাঁকে। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সুস্থতার জন্য দেশবাসীর দোয়া চাচ্ছি।
বাংলাদেশের মানুষ হিটলার মুসোলিনিকে দেখেনি। তবে তারা শেখ হাসিনাকে দেখেছেন। অবৈধ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে প্রতিপক্ষের ওপর নির্যাতন নিপীড়ন আর নির্বিচারে হত্যাকান্ড চালানোর রেকর্ড সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী। সন্দেহ নেই এক্ষেত্রে তিনি শতভাগ সফল। সাড়ে ১৫ বছরের হত্যা গুমের বিচার হলে বিশ্ববাসী জানবে হিটলার-মুসোলিনির পাশে আরও একটি নাম উচ্চারিত হবে কি না।
সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে প্রায় ১ হাজার শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিক শহীদ হয়েছেন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১৫ হাজার। আহতদের অনেকেই গুলিবিদ্ধ। কেউ না কেউ হাসপাতালে প্রাণত্যাগ করছেন প্রায় প্রতিদিন। শহীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। নিষ্ঠুরতার প্রতীক আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসনকালের সাড়ে ১৫ বছরে ৭ শতাধিক রাজনৈতিক কর্মী ও অন্য পেশাজীবী ব্যক্তি আয়নাঘরে গুম হয়েছেন। রাজপথের আন্দোলনেও পুলিশ বা অন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে বা লাঠিচার্জে এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগ মাস্তান বাহিনীর সশস্ত্র হামলায় নিহত হয়েছেন অনেকে। তাতে প্রকৃত শহীদের সংখ্যা সব মিলিয়ে বারো/তেরো শ’র নিচে নয়।
এবার আসা যাক অন্যসব গুরুতর অপরাধের ঘটনায়। নারী-ধর্ষণ, গণধর্ষণ, মারাত্মক নারী নিপীড়ন, শিশু-কিশোর-কিশোরী ধর্ষণ-বলাৎকার, হত্যা ও গুরুতর নির্যাতন, ব্যাংক-লুট, শেয়ার মার্কেট-দস্যুতা এবং ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অবাধ-লুণ্ঠন আরও নানারকম গুরুতর অপরাধ হয়েছে ক্ষমতাধর আওয়ামী লীগ নেতাদের সরাসরি অংশগ্রহণে কিংবা তাদের সমর্থকদের আশ্রয়-প্রশ্রয়-দানে। এর বাইরে সাধারণ অপরাধীদের অপরাধ তো হয়েছেই সরকারের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণে- ঘুষ ও মাদকদ্রব্যের চোরাকারবার এবং রাষ্ট্র-সম্পদ অবৈধ অর্জন বা দখলবাজিতে। অন্তত ৪০ লাখ কোটি টাকা আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী নামধারী দুর্নীতিবাজ ও ডাকাত-দস্যুরা (তাদের সমর্থক ঠিকাদার ও পুলিশ-কর্মকর্তা এবং অন্যসব আমলাসহ) রাষ্ট্র-সম্পদ থেকে লুটপাট করে নিয়েছেন একটানা দেড় দশক ক্ষমতাসীন থাকাকালে। তার মধ্যে কমপক্ষে ১২ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন তারা। এসব আওয়ামী লীগ অনুসারী দস্যু-ডাকাত-খুনির সংখ্যা ২ লাখের নিচে নয়। তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর দানব অন্তত কুড়ি হাজারের বিচার করতে হবে এক্ষুনি- এই অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদকালের মধ্যেই। অন্যদের বিচার-কাজ চালু থাকবে ধারাবাহিকভাবে।
এই বিচার কর্মকান্ডের যথার্থ সাফল্যের লক্ষ্যে অবিলম্বে পুলিশ ও অন্যসব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংস্কার করতে হবে- পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন ও তাকে দিয়ে উপযুক্ত কর্মকান্ড পরিচালনার মাধ্যমে। সেটি বেশ কঠিন কাজ; ‘প্রায়-অসম্ভব’ একটি রাষ্ট্রীয় তৎপরতা। তবে বর্তমান সরকারের সদিচ্ছা রয়েছে, ভরসা রাখা যায়। কিন্তু অতীতের সরকারগুলো প্রমাণ করেছে- তাদের কারও নেতৃত্বে এই কঠিন কাজটি সম্ভব নয়, একেবারেই সম্ভব নয়। কারণ আসল কথা হচ্ছে- তাদের মধ্যে সেই সততা ও আন্তরিকতা নেই। সদিচ্ছা নেই, সেই দক্ষতাও নেই, তারা সবাই দলকানা। নিজ নিজ রাজনৈতিক ক্ষুদ্র-স্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠার শক্তি-সাহস কোনোটাই নেই।
অতীতের স্বৈরাচার এরশাদ আমলের অগণন হত্যাকান্ডসহ নানা অপরাধের বিচার করা সম্ভব হয়নি প্রধান প্রধান দলের রাজনৈতিক হানাহানি ও হীনমন্য আচরণের কারণে। প্রেসিডেন্ট জিয়া হত্যাকান্ডের বিচার করা যায়নি, মূল হত্যাকারী (যা তথ্যপ্রমাণ বলে) তৎকালীন সেনাপ্রধান লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পরবর্তীকালে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নেওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি। কিন্তু স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পরও তার সহযোগীদের বিচার করা যায়নি। কেন যায়নি? কারণটা সম্ভবত এই যে, রাজনৈতিক নানা স্বার্থের হিসাব-নিকাশে এটা বাদ দেওয়া হয়েছে। স্মরণ রাখতে হবে এরশাদেরই প্রত্যক্ষ চক্রান্তে চট্টগ্রাম বিদ্রোহের বিচারের নামে জেনারেল আবদুর রহমানের (পরে মৃত বা ‘নিহত’) নেতৃত্বাধীন কোর্ট মার্শালে ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারের ফাঁসি দেওয়া হয়। অনেক মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারের জেল হয়, অনেকে চাকরি হারান। সে বিচার ছিল এরশাদের সাজানো নাটকের বিচার।
তারও আগে স্বাধীনতার প্রথম সাড়ে তিন বছরে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত সিরাজ শিকদার হত্যাসহ রাজনৈতিক হত্যাকান্ডগুলোর যার সংখ্যা কুড়ি হাজার কোনো বিচার হয়নি। স্বৈরাচার এরশাদ আমলের অবসানের পরের হত্যাকান্ডসহ গুরুতর অপরাধগুলোর বিচার করাও সম্ভব হয়নি। কারণ, রাজনৈতিক নানা স্বার্থ এ সময় ন্যায়বিচারের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।
অনেক হত্যাকান্ড, পাইকারি সন্ত্রাস, নানা অপরাধ ও অপরাধী গোষ্ঠীর হোতা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কীভাবে জামিন পেয়ে জেল থেকে বেরিয়ে আসছে এখন? কীভাবে প্রতিবেশী দেশের পলাতক-দশা থেকে দুঃসাহসী হয়ে দেশে ফিরছে তারা! এই হলো আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচারব্যবস্থার দুর্বলতার নমুনা। (আমরা কী ভুলে গেলাম- মাত্র দুই দশক আগে ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীর নরক-তান্ডবে ঢাকা নগরীসহ বিভিন্ন নগর-শহর গ্রামাঞ্চল ‘অপরাধীদের মাফিয়া-জগৎ’ সৃষ্টি করে জনজীবন ‘দোজখ’ বানিয়ে ছেড়ে ছিল। তাই তাদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন সৃষ্টিই হয়েছিল এসব ইবলিশ-গোষ্ঠীকে প্রতিরোধের লক্ষ্য নিয়ে। এ অবস্থায় কীভাবে আশা করা যায় যে, রাজনৈতিক নেতারা- ভবিষ্যতে পুরনো হত্যাকান্ড ও অন্যসব অপরাধের বিচার করবেন। পুলিশ বাহিনীর প্রকৃত সংস্কার করবেন, আসল রাষ্ট্র ও সমাজ সংস্কারের কাজ করবেন সর্বক্ষেত্রে এবং সফল হবেন?
৫ সেপ্টেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ খবর- ‘শেখ হাসিনার নামে ১১৯ হত্যা মামলা, তাঁর মন্ত্রীরাও আসামি’। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে : সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ-সংঘাতে বিপুলসংখ্যক লোক প্রাণ হারিয়েছে।
একই পত্রিকার খবরে (৬ সেপ্টেম্বর) বলা হয় : সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার (যিনি পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন) বিরুদ্ধে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দায়েরকৃত মামলার সংখ্যা ১৩৮টি, এর মধ্যে ১২৫টি হত্যা মামলা। এই লেখা তৈরির (৬ সেপ্টেম্বর) পরও তার বিরুদ্ধে আরও মামলা দায়েরের সম্ভাবনা রয়েছে। তা যদি না-ও হয়, এই যে ১৩৮টি মামলার বিচার কীভাবে কবে শুরু হবে সেটাই এখন বিশাল এক প্রশ্ন। সে প্রশ্ন শহীদদের পরিবার, ফ্যাসিবাদবিরোধী ও গণতন্ত্র, সুশাসনকামী সব শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক কর্মীদের এবং শান্তিপ্রিয় নিরীহ কোটি কোটি দেশবাসীর। এ ছাড়া রয়েছে আওয়ামী লীগ-কেন্দ্রিক সব ফ্যাসিবাদী সাবেক মন্ত্রী ও নেতাদের এবং আমলা ও ঠিকাদারদের অপরিসীম রাষ্ট্র-লুণ্ঠন, আন্দোলনকারী ও অন্যান্য রাজনৈতিক হত্যাকান্ড। তাদের অন্তত ২ লাখ ব্যক্তি আছেন যারা গুরুতর অপরাধী। তাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক অন্তত কুড়ি হাজার ব্যক্তির দ্রুত বিচার করা অতি জরুরি। কারণ এদের শাস্তিদানের মাধ্যমে ফাঁসি ও কারাদন্ড দিয়ে জেলে বন্দি না করা গেলে রাষ্ট্র ও সমাজ সংস্কার তো হবেই না, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান হবে অসম্ভব। তার চেয়েও বড় কথা এই লোকগুলো বর্তমান সরকারকে প্রতিমুহূর্তে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাবে।
তাই নিপীড়িত দেশবাসীর আকাক্সক্ষা- ছাত্র-জনতার এত আত্মদান যাতে বৃথা না যায়, সে লক্ষ্যে এই কুড়ি হাজার সর্বাপেক্ষা ভয়ংকর অপরাধীর বিচার এক্ষুনি শুরু করতে হবে এবং অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সমস্ত আদালতের বিচার-কর্মকান্ড সম্পাদন করতে হবে। সবকিছুর আগে মনুষ্যরূপী এই দৈত্য-দানবগুলোকে দ্রুততার সঙ্গে আটক করে (যারা ইতোমধ্যে পালিয়ে দেশের বাইরে চলে গেছেন তাদের ইন্টারপোলের মাধ্যমে ধরে এনে) জেলবন্দি করতে হবে। আর বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তারা যাতে কারাবন্দি থাকেন, যাতে জামিন নিয়ে পালিয়ে যেতে না পারেন, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার-আইনি প্রক্রিয়ায়।
প্রয়োজনে এসব অপরাধীকে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে দ্রুত বিচার করতে হবে। সে কাজে অনেক বাড়তি জনবল লাগতে পারে এবং সাধারণ বাজেটের বাইরে আরও ৫০০ কোটি টাকা বাড়তি ব্যয় বরাদ্দ দরকার হতে পারে। প্রয়োজনে তা অবিলম্বে বরাদ্দ করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো রকম সময়ক্ষেপণ আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও গণমানুষ একেবারেই সহ্য করবেন না।
♦ লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক