বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার বাকি আর মাত্র কয়েকটা দিন। জোর কদমে চলছে প্রস্তুতি। গত ২ অক্টোবর বুধবার পালিত হয়েছে মহালয়া। মহালয়া থেকে দেবীপক্ষের শুরু। ৯ অক্টোবর বুধবার ষষ্ঠী। দেবী দুর্গার বোধন। সপ্তমী তিথি থেকেই দুর্গাপূজার মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে। ১০ অক্টোবর বৃহস্পতিবার সপ্তমী। এবার চার দিন নয়, তিন দিনেই (১০-১২ অক্টোবর) শেষ হবে দুর্গাপূজা। ১১ অক্টোবর মহাষ্টমী। লোকনাথ পঞ্জিকা মতে এবার (১৪৩১ সন) মহানবমী ও দশমী পূজা একই দিনে পড়েছে; ১২ অক্টোবর শনিবার। বাংলাদেশে লোকনাথ পঞ্জিকা অনুসরণ করে থাকেন বেশির ভাগ মানুষ। বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকা অনুসারেও মহানবমী ও বিজয়া দশমী ১২ অক্টোবর। পশ্চিমবঙ্গে বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকা বহুল প্রচলিত। গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা অনুযায়ীও মহানবমী ও দশমীর পূজা একই দিনে ১২ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে। তবে এর ব্যতিক্রম আছে। বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা মতে, বিজয়া দশমী ১৩ অক্টোবর রবিবার। রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠগুলোতে বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকার সময়সূচি অনুযায়ী দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এবার সারা দেশে ৩২ হাজার ৬৬৬টি পূজামন্ডপে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছে।
বছর বছর দেবী দুর্গা সন্তান-সন্ততি নিয়ে আসেন মর্ত্য।ন্ডে কদিন ‘বাপের বাড়ি’তে অবস্থানের পর ফিরে যান স্বামী শিবের কাছে, কৈলাস পর্বতে। এবারও এর অন্যথা হবে না। কখনো গজ অর্থাৎ হাতি, কখনো ঘোটক অর্থাৎ ঘোড়া, কখনো নৌকা, আবার কখনোবা দোলা অর্থাৎ পালকিতে চড়ে দেবী দুর্গা মর্ত্যে আগমন বা কৈলাসে গমন করেন। সাধারণত প্রতি বছর দুর্গার আগমন ও প্রত্যাবর্তন একই বাহনে হয় না। কোনো বছর এমনটা হলে তা অশুভ বলেই মনে করা হয়। তবে এ বছরে এমনটা হচ্ছে না। প্রতি বছর দুর্গার আগমন ও গমনের বাহনও বদলে যায়। এর পেছনে আছে বারের হিসাব। হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী, সপ্তমী তিথি রবি বা সোমবার হলে দেবী দুর্গার মর্ত্যে আগমনের বাহন হবে হাতি। আবার সপ্তমী শনি বা মঙ্গলবার হলে দেবীর বাহন ঘোড়া। অন্যদিকে সপ্তমী বৃহস্পতি বা শুক্রবার হলে দেবীর বাহন হবে পালকি। সপ্তমী বুধবার হলে দেবীর বাহন নৌকা।
শাস্ত্রমতে, দশমী রবি বা সোমবার হলে দুর্গার কৈলাসে প্রত্যাবর্তনের বাহন হবে হাতি। দশমী শনি বা মঙ্গলবার হলে দেবী বিদায় নেবেন ঘোড়ায় চড়ে। আবার দশমী বৃহস্পতি বা শুক্রবার হলে দেবীর গমন হবে পালকিতে। আর দশমী বুধবার হলে দেবী নৌকায় করে কৈলাসে ফিরবেন। [তথ্য সূত্র : সংবাদ প্রতিদিন, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪।]
দেবী দুর্গার বাহন নিয়ে বাঙালি সমাজে বহু লোককথা প্রচলিত আছে। এর সঙ্গে শুভ-অশুভর নাকি যোগ আছে! শাস্ত্রমতে, দেবীর সবচেয়ে ভালো বাহন হাতি। দেবীর বাহন হাতি হলে মর্ত্যলোক অর্থাৎ পৃথিবী নামের আমাদের এ গ্রহ ভরে ওঠে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধিতে। দেবীর বাহন নৌকা হলে ধরিত্রী হয়ে ওঠে শস্য-শ্যামলা। পঞ্জিকা মতে, এবার দেবীর আগমন পালকিতে। ঘোড়ার পিঠে আসীন হয়ে কৈলাসে ফিরে যাবেন দেবী দুর্গা। এবার আসা বা যাওয়ার বাহন কোনোটারই ফল শুভ নয়, এমনটাই বিশ্বাস ভক্ত মহলে। দুর্গার বাহনের সঙ্গে শুভ-অশুভর আদৌ কোনো যোগ আছে কি না তা গবেষকদের গবেষণার বিষয় হতে পারে।
যিনি দুর্গতি থেকে রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা। উমা, ভগবতী, পার্বতী, গৌরী, মহামায়ার মতো নানা নামে দুর্গাকে ডাকি আমরা। পুরাণে বর্ণিত কাহিনি অনুসারে, পুরাকালে মহিষাসুর নামে এক অসুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে স্বর্গের দেবতারা স্বর্গলোক ত্যাগ করতে বাধ্য হন। কঠোর তপস্যার পর ব্রহ্মার কাছ থেকে বর লাভ করেছিলেন মহিষাসুর, ত্রিলোকের কোনো পুরুষই তাকে পরাস্ত করতে পারবে না। অতএব কী দাঁড়াল? মহিষাসুরকে পরাভূত করতে পারবেন কোনো নারী। ব্রহ্মার বলে বলীয়ান হয়ে মহিষাসুর স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল অধিকার করে নেয়। সে অপরাজেয় হয়ে ওঠে। অবশেষে অসুরকে বধ করতে দেবতারা সৃষ্টি করেছিলেন এক নারীশক্তি। ব্রহ্মা, বিঞ্চু ও মহেশ্বরের মিলিত তেজে নারীশক্তি মহামায়ার আবির্ভাব হয়। দেবতারা নিজেদের সেরা অস্ত্রগুলো তুলে দেন দশভূজা দেবী দুর্গার হাতে। দেবী রুদ্ররূপ ধারণ করলেন। দুর্গার রণহুঙ্কারে ত্রিভুবন কেঁপে উঠল। তুমুল যুদ্ধের পর ত্রিশূল দিয়ে বক্ষ বিদীর্ণ করে মহিষাসুরকে বধ করলেন দেবী। স্বর্গ থেকে বিতাড়িত দেবতারা স্বর্গের অধিকার ফিরে পান। পুরাণে বর্ণিত এ কাহিনি নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীশক্তির বিজয় চিহ্নিত করে।
দুর্গাপূজা আয়োজনে প্রচুর খরচ হয়। অর্থবলের পাশাপাশি লোকবলও লাগে। একটা সময় ছিল যখন মূলত বাংলার হিন্দু জমিদার-রাজা-মহারাজারাই দুর্গোৎসবের আয়োজন করতেন। এলাকার সব মানুষ যোগ দিতেন সে উৎসবে। মনে করা হয়, অবিভক্ত বাংলায় প্রথম ধুমধাম করে দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন রাজশাহীর কংসনারায়ণ রায়। এটা ষোড়শ শতকের (১৫০১-১৬০০) মাঝামাঝি সময়ের কথা। ধনীগৃহে আয়োজিত পূজায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল বটে, কিন্তু তা মোটেই অবাধ ছিল না। ছিল নানা বিধিনিষেধ। প্রায় আড়াই শ বছর আগে ১৭৯০ সালে হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ায় আয়োজিত হয় প্রথম বারোয়ারি পূজা। দুর্গাপূজার আখ্যান অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির বিজয়ের। নিজের মনের ভিতরের অসুরকে যেন আমরা বিনাশ করতে পারি, দেবী দুর্গার কাছে এটাই আমাদের একান্ত প্রার্থনা।
♦ লেখক : সাবেক ব্যাংকার