বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (কেজিডিসিএল)। নিয়ম অনুযায়ী, দেশের অন্যান্য গ্যাস বিতরণ কোম্পানির মতোই কেজিডিসিএলকেও গ্যাস বিক্রির সব অর্থ পেট্রোবাংলায় জমা দেওয়ার কথা। কিন্তু কেজিডিসিএলের আরেক প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানির (কাফকো) কাছে গ্যাস বিক্রি করে অতিরিক্ত যে অর্থ লাভ করেছে (প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি) এখনো পেট্রোবাংলাকে বুঝিয়ে দেয়নি। এ ব্যাপারে পেট্রোবাংলা কর্তৃপক্ষ একাধিকবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠালেও এখনো বিষয়টির সুরাহা হয়নি। আর কেজিডিসিএলের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলছেন, মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা এলেই তারা সঙ্গে সঙ্গেই এ টাকা পেট্রোবাংলাকে দিয়ে দেবে।
জানা যায়, গত এক যুগের বেশি সময় ধরে জমে থাকা এই বকেয়া বিলের জন্য পেট্রোবাংলার আর্থিক দুর্দশা আরও বেড়েছে। এই অবস্থায় আমদানিকৃত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) এবং আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে যে গ্যাস কিনতে হচ্ছে তার মূল্য পরিশোধে পেট্রোবাংলাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিষয়টি সুরাহার জন্য পেট্রোবাংলা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়ার পাশাপাশি গত বছর এজন্য একটি তদন্ত কমিটির সুপারিশ করলেও সেটি উপেক্ষা করে কেজিডিসিএল কর্তৃপক্ষ বছরের পর বছর জমাকৃত এই তহবিল থেকে লাভবান হচ্ছে।
পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, কেজিডিসিএল, কাফকোর কাছে গ্যাস বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করছে। এই মূল্য বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) দেশের অন্য সার কোম্পানিগুলোর জন্য নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি। সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানায় ভর্তুকি দিয়ে গ্যাস সরবরাহ করে। তবে কাফকোকে বেশি দামে গ্যাস কিনতে হয়। বিইআরসির মতে, কেজিডিসিএলের চার্জ বাদে গ্যাস বিক্রির সব আয় পেট্রোবাংলাকে পরিশোধ করার কথা। কিন্তু ২০১০ সালে কোম্পানিটির অন্তর্ভুক্তির পর এমনটি ঘটেনি। ২০১৯ সাল পর্যন্ত কাফকোর কাছে গ্যাস বিক্রি করে কর্ণফুলী গ্যাসের অতিরিক্ত আয়ের পরিমাণ ছিল প্রতি ইউনিট ৯ টাকা ২৯ পয়সা। এটি কাফকোর জন্য প্রতি ঘনমিটারে ১২ টাকা করে দিতে হয়। আর বিইআরসির নির্ধারিত মূল্য ২ টাকা ৭১ পয়সা। তবে ২০২২ সালের জুনে কাফকো থেকে কর্ণফুলী গ্যাসের অতিরিক্ত আয় প্রতি ঘনমিটারে ৭ টাকা ৫৫ পয়সা কমেছে। কারণ, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ২০১৯-এর ৩০ জুন থেকে সারের দাম ৪ টাকা ৪৫ পয়সা বৃদ্ধি করে। ২০২৩ সালের ১৮ জানুয়ারির সর্বশেষ শুল্ক সমন্বয় অনুযায়ী, কেজিডিসিএল এখন কাফকোর কাছে প্রতি ইউনিট ৩০ টাকায় গ্যাস বিক্রি করে যেখানে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সার কোম্পানিগুলোর জন্য রেট হলো ইউনিট প্রতি ১৬ টাকা।
কাফকোর কাছে গ্যাস বিক্রি থেকে অর্জিত অতিরিক্ত গ্যাসের মূল্য ধরে রাখতে, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ ২৩ জুলাই ২০২৩-এ একটি কমিটি গঠন করে। দুই মাস পর, কমিটি দুটি সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন পেশ করে। এতে বলা হয়, কাফকো সার ক্যাটাগরিতে গ্যাসের দামের জন্য বিইআরসি-নির্ধারিত হার পরিশোধ করবে, অতিরিক্ত শুল্কের পরিমাণ সরাসরি পেট্রোবাংলাকে প্রদান করবে এবং পেট্রোবাংলা এবং কেজিডিসিএল কর্তৃপক্ষ নিজেদের সঠিক প্রাপ্য নির্ধারণ করবে। কিন্তু এই প্রতিবেদন দাখিলের এক বছর পার হলেও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বাংলাদেশ গতকাল প্রতিদিনকে বলেন, আমরা কেজিডিসিএলের কাছে যে টাকা পাই তা এলএনজি ক্রয়ের জন্য চেয়েছিলাম। আমরা কেজিডিসিএল কর্তৃপক্ষকে বলেছিলাম যে, তারা নিজেদের মার্জিন পেতে পারে। এর বেশি তারা পাবে না। আমি দায়িত্বে আসার পর গত দেড় বছর চেষ্টা করেও এই টাকা ফিরে পাইনি। এ সময় এই অর্থ উদ্ধারে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে আমি চার থেকে পাঁচবার চিঠি দিয়েছি। মূলত মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তেই এমনটি হয়েছিল। আমরা মন্ত্রণালয়কে বারবার বিষয়টি বলে দেওয়ার জন্য বলেছিলাম। কিন্তু মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
কেজিডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল মান্নান পাটওয়ারী গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আসলে এটি অনেকদিন আগের একটি ডিসপিউট। অতিরিক্ত যে টাকা তা কর্ণফুলী গ্যাস তাদের অপারেশনাল কার্যক্রমসহ অন্যান্য খরচে ব্যয় করত। পরে সিদ্ধান্ত হলো, অতিরিক্ত মুনাফার টাকা ফিফটি-ফিফটি করে দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রাখা হবে। এভাবেই একটি আলোচনা চলছিল। পেট্রোবাংলা এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত এলেই অতিরিক্ত টাকা পেট্রোবাংলাকে দিয়ে দেওয়া হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা জানান, জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কর্ণফুলী গ্যাস পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন, যারা বিতরণ কোম্পানিকে তহবিল আটকে রাখার ব্যাপারে সমর্থন জানিয়েছেন। কর্ণফুলী গ্যাসের অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী, জ্বালানি বিভাগের সচিব কোম্পানির গভর্নিং বডির চেয়ারম্যানের পদে অধিষ্ঠিত এবং কোম্পানির নয়জন বোর্ড সদস্যের মধ্যে চারজন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের।