শনিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

আত্মহত্যা প্রতিবাদের অস্ত্র হতে পারে না

আত্মহত্যা প্রতিবাদের অস্ত্র হতে পারে না

বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস আজ।

ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশন (আইএএসপি) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) যৌথভাবে প্রতি বছর ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী পালন করে দিবসটি। এবারের প্রতিপাদ্য : Connect-Communicate-Care। সোসাইটি ফর সুইসাইড প্রিভেনশন বাংলাদেশ (এসএসপিবি), ব্রাইটার টুমোরো ও নানা প্রতিষ্ঠানও জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষে বাংলাদেশে দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। 

আত্মহত্যা প্রতিরোধে ঝুঁকিপ্রবণদের পাশে সম্পৃক্ত বা Connect থেকে তাদের জীবনরক্ষায় কাজ করার জন্য বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তি বিশেষকে আহ্বান জানিয়েছে আইএএসপি ও ডব্লিউএইচও। সহযোগিতার হাত প্রসারিত হলে এ ধরনের বিয়োগান্ত ঘটনা সংঘটিত হওয়ার আগেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। ঝুঁকিপূর্ণদের শনাক্ত করতে হবে, মনোযোগ দিয়ে সহানুভূতি সহকারে শুনতে হবে তাদের কষ্ট ও জীবনযন্ত্রণার কথা। কারও মনে আত্মহত্যার ইচ্ছা, পরিকল্পনা উদয় হলে অ্যাটেম্পট গ্রহণ করার আগেই তাদের আচরণ, কথাবার্তায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে; ধীরে ধীরে সবার মাঝ থেকে আড়ালে চলে যেতে থাকে, নিজের মধ্যেই নিজেকে আচ্ছন্ন করে ফেলে—এভাবে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আত্মহত্যা করে ফেলে। এটি হচ্ছে পরিকল্পিত সুইসাইডের একটি প্রক্রিয়া। কোনোমতেই তাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার সুযোগ দেওয়া যাবে না। আচমকা আত্মহত্যাকারীরা আচরণগত ও ব্যক্তিত্বের সমস্যার কারণে পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে তাত্ক্ষণিক সুইসাইড করে বসে। পরিকল্পনাকারী ও আচমকা আত্মহত্যাকরী ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের বিষয়ে ধারণা লাভ করে আগেই তাদের পাশে দাঁড়ানো মানবিক দায়িত্ব হিসেবে দেখতে চায় সুইসাইড প্রতিরোধে কর্মরত দেশি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ। আত্মহত্যা করার পর তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর কোনো সুযোগ নেই, উচিতও নয়। আত্মহত্যার ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিকে মনে রাখতে হবে সুইসাইড মানে আইন লঙ্ঘন করা, অপরাধ করা। সুইসাইড মানে ধর্মীয় অনুশাসন অবজ্ঞা করা, সমাজকে পেছনের দিকে ঠেলে দেওয়া। সুইসাইড কখনো প্রতিবাদের অস্ত্র হতে পারে না; প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে না। আত্মহত্যার ইচ্ছা, আগ্রহ জয় করতে হবে। জয় করার নামই জীবন। জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়া হচ্ছে কাপুরুষতা। স্বজনদের মনে রাখতে হবে কেউ আত্মহত্যা করার কথা (Intent) বললে, আত্মহত্যা করব বলে থ্রেট (Threat) করলে বা ভয় দেখালে তা কোনভাবেই অবজ্ঞা করা উচিত নয়, অবহেলার চোখে বিবেচনা করা চলবে না বরং নিজের বিচার-বিবেচনাবোধ আড়ালে রেখে তার কথা ও মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রাণ উজাড় করে  তাকে সব কথা বলার পরিবেশ তৈরি করতে হবে, আত্মহত্যার বিষয়ে তার কগনিশন বা চিন্তনের খুটিনাটি বিষয়গুলো বলার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে, তার আবেগ বুঝতে হবে, সমস্যাটি ধরতে হবে। আরও মনে রাখতে হবে, ‘Suicide is a symptom not a disease’  অর্থাৎ উপসর্গের আড়ালে চাপা থাকা কারণ বা সমস্যা ধরতে হবে এবং সর্বোচ্চ মানসিক স্বাস্থ্য সেবাগ্রহণের (Care) জন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট  অন্যান্য পেশাজীবীদের সাহায্য নিতে হবে।

বাংলাদেশে সুইসাইডের হার প্রতিবছর লাখে ৮-১০ জন। পক্ষান্তরে বিশ্বজনীন এই হার প্রতিবছর লাখে ১৪.৫। বাংলাদেশের ঝিনাইদহ ও যশোর জেলাকে আত্মহত্যাপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে— গড়ে এই হার ২৯-৩৩ জন। ঝিনাইদহে আত্মহত্যাকারীদের ৬৭.২৮% ছিল গৃহবধূ, ৭৩.৪৫% মহিলা, ৬৯.৫৬% অশিক্ষিত, ৭৪.৬১ শতাংশের বয়স ছিল ১১-২৫ বছরের মধ্যে। বাংলাদেশ জার্নাল অব সাইকিয়াট্রিতে রিভিউ আর্টিকেল হিসেবে প্রকাশিত এ গবেষণাপত্র থেকে আরও দেখা যায়, ৩৭-৫৯% সুইসাইড ঘটেছে পারিবারিক সমস্যার কারণে (আলম এম এফ’০৪)। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে, মরণপ্রবৃত্তির অন্তর্মুখিতা সুইসাইড ঘটায়। সহিংসতা অন্তর্মুখী হলে নিজেকে নিঃশেষ করার প্রবৃত্তি জোরালো হয়ে ওঠে। নিজেকে খুন করে মানুষ।  আইনের চোখেও আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকারী একজন অপরাধী। আত্মহত্যার পর যেমন থানায় খবর দিতে হয়, তেমনি আত্মহত্যার চেষ্টা করলেও থানায় খবর জানানোর কথা বলা হয়েছে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক ওয়াজিউল আলম চৌধুরী সভাপতি, সোসাইটি ফর সুইসাইড প্রিভেনশন বাংলাদেশ, অধ্যাপক মোহিত কামাল, মহাসচিব, সোসাইটি ফর সুইসাইড প্রিভেনশন বাংলাদেশ

সর্বশেষ খবর