মানুষ কখনো অন্যায়ের মাধ্যমে অন্যায়কে প্রতিহতের চেষ্টা করে। সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য অবিচার করা শুরু করে। এটা হয় এমন কিছু সংখ্যাগরিষ্ঠের দ্বারা, যারা কোনো কারণে ক্ষমতার কেন্দ্রে পরিণত হয় বা সাধারণ আইনের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। তাদের মনে জমা ক্ষোভ, অবিশ্বাস বা নৈতিক ন্যায়নিষ্ঠতার অভাবে তারা ইনসাফ কায়েমের নামে নিজেদের আক্রোশ মেটানোয় প্রবৃত্ত হয়।
এভাবে আদর্শিক অভ্যুদয়ের দারপ্রান্তে এসে একটি সমাজে শুরু হয় ‘মব জাস্টিস’ বা ‘উচ্ছৃঙ্খল গণবিচার’ সংস্কৃতি। ছড়িয়ে পড়ে নৈরাজ্যবাদ।
মব জাস্টিস আইনগতভাবে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়, কারণ এটি সমাজের জন্য ক্ষতিকর এবং সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে বড় বাধা। এর ফলে অনেক সময় নিরীহ মানুষও অন্যায়ের শিকার হয়ে পড়ে।
মব জাস্টিস কী?
এটি একটি অবজ্ঞাসূচক শব্দ। মব (Mob) অর্থ উত্তাল জনতা বা উচ্ছৃঙ্খল জনতা। জাস্টিস (Justice) অর্থ বিচার বা ন্যায়বিচার। ‘মব জাস্টিস’ অর্থ উত্তাল জনতা বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিচার।
একে উচ্ছৃঙ্খল গণবিচার, মব রুল বা মবোক্রেসি বা ওখলোক্রেসি বলেও প্রকাশ করা হয়।
‘মব জাস্টিস’ (Mob Justice) বলতে আইন জনতার নিজের হাতে তুলে নেওয়াকে বোঝানো হয়। সাধারণত কোনো অপরাধ বা অপরাধীকে আইনানুগ প্রক্রিয়ায় বিচার না করে, উত্তেজিত জনতা নিজেরাই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করে। এ ধরনের ঘটনা সাধারণত আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা, বা অপরাধের প্রতি দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানানো থেকে ঘটে।
মব জাস্টিসের উৎস মূল
মব জাস্টিস (Mob Justice) সাধারণত কয়েকটি ধাপে সংঘটিত হয়।
এ ধরনের ঘটনাগুলো হঠাৎ উত্তেজনার পরিবেশে ঘটে, এবং নিম্নলিখিত ধাপগুলো এর প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করে—
১. ঘটনার সূত্রপাত : কোনো অপরাধ বা অন্যায় ঘটলে (যেমন—চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ বা হত্যার অভিযোগ) স্থানীয় জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
২. গুজব ও ভুল তথ্যের প্রচার : এ সময় সোস্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফরমে নানা ধরনের গুজব, ভুল তথ্য বা বিষয়টিকে খুব বাড়িয়ে প্রচার করা হতে থাকে। অনেক সময় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জনসাধারণকে উসকে দেওয়া হয়।
৩. উত্তেজনা বৃদ্ধি : যখন মানুষ মনে করে যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যথেষ্ট দ্রুত বা কার্যকরভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছে না, তখন গুজব, ভুল তথ্যের প্রচার বা কোনো অসাধু মহলের উসকানিতে লোকজনের মধ্যে দ্রুত উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
৪. অভিযুক্তের ধরপাকড় ও নৃশংসতা : উত্তেজিত জনতা যেকোনো উপায়ে অভিযুক্তদের পাকড়াও করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কাছে তাদের হস্তান্তর না করে নিজেরাই শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করে। এটি হতে পারে মারধর, নির্যাতন বা আরো গুরুতর সহিংসতার মাধ্যমে। এমনকি হত্যার ঘটনাও ঘটে। অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের সহিংসতা প্রমাণবিহীন বা বিচার ছাড়াই ঘটতে পারে।
৫. পরিণতি ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর
হস্তক্ষেপ : যখন পরিস্থিতি খুবই গুরুতর হয়ে ওঠে, তখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ঘটনাস্থলে এসে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করে। কিন্তু ততক্ষণে সহিংসতা ঘটে যায়। প্রায়ই অপরাধীরা পালিয়ে যায় এবং অনেক সময় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বা দেরি হয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর যথাযথ হস্তক্ষেপ না থাকায় এটি বারবার ঘটতে থাকে।
মব জাস্টিসের পরিণতি
মব জাস্টিসের (Mob Justice) পরিণতি সাধারণত অনেক গুরুতর ও ধ্বংসাত্মক হয়, যা ব্যক্তি, সমাজ এবং আইনি ব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কখনো কখনো নিরীহ ব্যক্তির মৃত্যুও ঘটে। সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়। অপরাধের সংস্কৃতি বৃদ্ধি পায়।
এসব পরিণতির কারণে মব জাস্টিসকে দমন করতে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
মব জাস্টিসের প্রতিকার
পৃথিবীতে শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করাই ইসলামের মূল আবেদন। মানুষের ব্যক্তিজীবন থেকে পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবন সর্বত্র যেন ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পায়, সে জন্য ইসলামে রয়েছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘অবশ্যই আল্লাহ ইনসাফ, ন্যায়বিচার ও সদাচারের আদেশ করেছেন।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৯০)
একই নির্দেশনা দিয়ে অন্য আয়াতে বলেছেন, ‘অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের আদেশ করেছেন যে আমানতসমূহ প্রাপকদের নিকট পৌঁছে দেবে এবং যখন মানুষের মধ্যে বিচার মীমাংসা করবে তখন ইনসাফ ও ন্যায়বিচার করবে।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৫৮)
ইসলামের এই সুমহান আবেদনের কাঙ্ক্ষিত সমাজ গঠনে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো মব জাস্টিস প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে—
১. পরকালমুখী মানসিকতা গঠন : ইসলামী জীবনব্যবস্থায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠার অন্যতম অনুঘটক হলো মানুষের অন্তরে রোপিত পারলৌকিক জীবনবোধ ও ঐশ্বরিক চেতনা, যা মানুষকে প্রকাশ্য এবং গোপন সব রকম অন্যায় ও অবিচার থেকে বিরত রাখে এ কারণে যে আল্লাহ কিয়ামতের দিন বিচারের আদালত স্থাপন করবেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আমি ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের আদালত স্থাপন করব। কারো প্রতি সামান্য পরিমাণ অবিচার করা হবে না। এমনকি মানুষের সরিষার দানা পরিমাণ ক্ষুদ্র কর্ম ও আচরণও আমি সেদিন উপস্থিত করব। হিসাব গ্রহণের জন্য আমিই যথেষ্ট।’
(সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৪৭)
২. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও কার্যকর আইন
প্রয়োগ : দক্ষ, স্বচ্ছ ও নৈতিকতা সম্পন্ন বিচার বিভাগ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী গঠন করে দ্রুততর সময়ে সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া; যাতে মানুষ আইনের প্রতি আস্থা না হারায় এবং নিজেদের হাতে আইন তুলে নিতে উৎসাহিত না হয়।
৩. সচেতনতা বৃদ্ধি ও নৈতিক মানসিকতা
গঠন : জনসাধারণের মধ্যে আইনি সচেতনতা বৃদ্ধি, নৈতিক ও মূল্যবোধসম্মত শিক্ষা দিয়ে বোঝানো উচিত যে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া অনৈতিক এবং এটি সমাজের জন্য ক্ষতিকর। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সুতরাং তোমরা ন্যায়বিচার করতে প্রবৃত্তির অনুসরণ কোরো না।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১৩৫)
৪. গুজব প্রতিরোধ : মব জাস্টিসের অনেক ঘটনাই গুজবের ভিত্তিতে ঘটে। এটি অনেক বড় পাপ। হাদিসের ভাষায়, ‘যা কিছু কানে আসে কোনো রূপ যাচাই-বাছাই ছাড়া তা বলে বেড়ানো মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট।’ তাই গুজব প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
৫. বিচারব্যবস্থায় মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা : মামলা নিষ্পত্তির সময় কমানো, তদন্তের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং দুর্নীতিমুক্ত প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে বিচারব্যবস্থায় আস্থা ফিরিয়ে আনা।
৬. অপরাধের মূল কারণ সমাধান : মব জাস্টিস অনেক সময় সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্যের কারণে ঘটে। তাই সমাজে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সুশিক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার, যাতে অপরাধপ্রবণতা কমে।
৭. স্থানীয় নেতৃত্ব, প্রযুক্তি ও মিডিয়ার ভূমিকা : সমাজের সম্মানিত ব্যক্তি, ধর্মীয় নেতা এবং সমাজসেবীরা সমাজে শান্তি ও ন্যায়বিচার বজায় রাখতে উৎসাহিত করতে পারেন। মিডিয়া এবং সামাজিক মাধ্যমে সঠিক খবর ও তথ্য প্রদান করে জনগণকে বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করতে পারে।
এই পদক্ষেপগুলো কার্যকরভাবে গ্রহণ করা হলে মব জাস্টিসের মতো অপরাধগুলো ধীরে ধীরে সমাজ থেকে দূর করা সম্ভব।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন