কোটা আন্দোলন আদালতে মীমাংসিত বিষয়। এরপরও নানা ধরনের দফা দিয়ে আন্দোলন হচ্ছে। বিষয়গুলো তলিয়ে দেখা প্রয়োজন। এতো কিছু প্রাপ্তির পরও কারা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে? কোটা আন্দোলনের নামে জ্বালাও পোড়াও করেছে। এ সবকিছুর আলামত ভালো নয়। আন্দোলনের ধরন দেখে মনে হয় এটি দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল।
সোমবার সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘সন্ত্রাস, নাশকতা ও বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক মুক্ত আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
আলোচনার আয়োজক মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গৌরব ’৭১।
প্রধান আলোচক আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ মাহবুবউল আলম হানিফ এমপি বলেন, ২১ জুলাই আপিল বিভাগ যখন কোটা সংস্কার করে রায় দিলেন-দেশবাসী ভেবেছিলেন আন্দোলনের আর প্রয়োজন হবে না। কোটা সংস্কার নিয়ে ছাত্রদের যা প্রত্যাশা ছিল তার চেয়ে বেশিই পেয়েছে। কিন্তু এরপর নতুন মাত্রায় সহিংসতা শুরু হলো। কারণ বিএনপি-জামায়াত সরকার পতনের একদফা দাবি বাস্তবায়নে কৌশলে ছাত্রদের পেছনে অবস্থান নিলো। মূল খেলোয়াড় তো ছাত্র নয়। এই আন্দোলনের মূল খোলোয়াড় বিএনপি-জামায়াত।
হানিফ বলেন, আমরা একটা জায়গায় ভুল করে যাচ্ছি। এটা ছাত্র আন্দোলন নয়, ছাত্রদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত যখন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বানচাল করতে ব্যর্থ হলো। তারপর আমরা ভেবেছি বিপদমুক্ত, কিন্তু না। তারা নির্বাচন বানচালে ব্যর্থ হয়ে সরকার গঠনের পর নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করে।
তিনি বলেন, কোটা আন্দোলনে সৃষ্ট সহিংসতায় ১৪৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে শিক্ষার্থী আছে, চারজন পুলিশ, চারজন সাংবাদিক, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের ১৯ জন মারা গেছেন। এছাড়া শ্রমিক, রিকশাচালক, হকারও মারা গেছে। এই মৃত্য ও ধ্বংসযজ্ঞ কাম্য নয়।
সভাপতির বক্তব্যে সংসদের হুইপ ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য এডভোকেট সানজিদা খানম এমপি বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা কখনোই বৈষম্যকে পাত্তা দেন না। দল মত নির্বিশেষে সবার জন্য ব্যবস্থা করেছেন-তাহলে কেন এই অবস্থা হবে? আমাদের বোধদয় হওয়া দরকার। বাংলাদেশ অনেক রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে, ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। আসুন সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে থাকি। শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণ হয়েছে-তারা যেন ঢাল হিসেবে ওই অপশক্তিকে আর সুযোগ না দেয়।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন এমপি বলেন, ছাত্রদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে দুষ্কৃতিকারীরা যারা আওয়ামী লীগকে সহ্য করতে পারে না, যারা বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা দেখতে চায় না তারা এমন ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারে। যারা আন্দোলনকে উসকে দিয়েছে তারা বিদেশে সুরক্ষিত, তাদের সন্তানেরা বিদেশে সুরক্ষিত, তারা দেশে শিক্ষার্থীদের উসকে দিচ্ছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মশিউর রহমান বলেন, বাঙালির যতবার ক্রান্তিকাল এসেছে ততবার বাঙালির শক্তির উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত। যতবার বঙ্গবন্ধুর কাছে ফিরে যাওয়া যায়, ততবার সমাধানের সুস্পষ্ট পথও পাওয়া যায়।
তিনি আরো বলেন, যতবার সাহস হারাই, ততবার অনুপ্রেরণার উৎস হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো, মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষকে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় না আনা, বরং ক্ষেত্রেবিশেষে উদারভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করি। শুধু দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ নিশ্চিত করলেই হবে না, সাংস্কৃতিক জাগরণের মধ্য দিয়ে অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করতে হবে।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, নাশকতার ষড়যন্ত্র ছিল বলা হচ্ছে, কিন্তু এই নাশকতা কীভাবে হলো? এটি দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ। ৯ ও ১৭ জুলাই বিদেশি মিশনে আন্দোলনকে চাঙা করার জন্য বৈঠক হয়েছে। গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য ছিল। তথ্য থাকা সত্ত্বে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। দেশের অধিকাংশ জনগণ কোটা সংস্কারের পক্ষে ছিল। এটা গোড়াতেই সমাধান করা যেতো। আমরা বুঝতে পারিনি তৃতীয় কোনো পক্ষ আন্দোলনে ঢুকে পড়েছে। ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা অনেক দিন ধরেই হচ্ছে, আমরা বুঝতে পারিনি।
আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজল্যাণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন বলেন, বিশ্বের কোথাও এমন আছে যেখানে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর পরাজিত শক্তি আস্ফালন দেখায়? এই ক্ষতবিক্ষত বাংলাদেশ কি আমরা কল্পনা করেছিলাম। মৃত্যু যারই হোক-পুলিশ-শিক্ষার্থী, এক ফোঁটা রক্ত ঝরুক আমরা চাইনি। ১৫ তারিখ পর্যন্ত কাউকে ফুলের টোকা দেয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগকে নির্দেশ দিলেন তোমরা বের হয়ে যাও, তারা লাশ ফেলতে চায়। আমরা তো এক ফোঁটা রক্ত ঝরুক, চাইনি। কিন্তু জাতিকে বুঝাতে পারিনি। ওরা যখন লাশ ফেলতে পারেনি, তখন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে বিকৃত করেছে। ২০১৩ সালে হেফাজতের সময় বলা হয়েছে ১০ হাজার মারা গেছে। পরে দেখা গেলা ৪৩ জন। এরপর গণমাধ্যমে খুঁজে দেখলো মৃত্যু তালিকায় যাদের নাম তারা কেউ মক্তবে, কেউ কাজে। আমরা হেফাজত আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিতে পারিনি।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শাহীনুর রহমান বলেন, যে বিষয় মীমাংসিত এরপরও নানা দফায় আন্দোলন হচ্ছে-বিষয়গুলো তলিয়ে দেখা প্রয়োজন। এতো প্রাপ্তির পরও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে, এই পক্ষ কারা। কোটা আন্দোলনের নামে তারা জ্বালাও পোড়াও করেছে। নতুন নতুন সমন্বয়ক যোগ করা হচ্ছে। এসব আলামত ভালো নয়। থানা লুট করা হয়েছে, টার্গেট করে বিভিন্ন কথা বলা হচ্ছে। দেশে কেন এই ধরনের নৈরাজ্য ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম? এর পেছনে কারা? সুযোগ পেল কেন? চিহ্নিত করে সমুচিত শাস্তি দিতে হবে। স্বাধীন সার্বভৌম দেশ পেয়েছি, মুক্তি পাইনি। এটা জাতির পিতার নির্দেশ, দুর্গ গড়ে তুলে প্রতিরোধ করতে হবে।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সহ-সভাপতি ঝুনা চৌধুরী বলেন, আমরা নিশ্চিত ছিলাম, বর্তমান প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগ্রত। কিন্তু এদের মধ্যে ঢুকে গেছে দেশবিরোধীরা। অনেকেই বলেন কোমলমতি শিক্ষার্থী কিন্তু আমি যা দেখেছি তাতে এটা বলতে আমার কষ্ট হয়। অনেকে বলেন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ছিল না, তাহলে ৪৩ জন মারা গেল-এরা কারা? আমাদের দাবি, উপযুক্ত প্রমাণ সাপেক্ষে এগুলো যেনো বিচারের আওতায় আনা হয়।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক আহকাম উল্লাহ বলেন, তরুণরা কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু করেছিল। পরে কোটা বিরোধী আন্দোলন এবং তারপর জামায়াতের ক্যাডাররা ঢুকে যাওয়ার পর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন হয়ে গেল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় জানিয়েছে ১৪৭ জন মারা গেছেন, এর মধ্যে আওয়ামী লীগের কর্মী ৪৩ জন। সাংবাদিক, পুলিশ, র্যাবকে হত্যা করা হয়েছে। টার্গেটেড ভিকটিম ছিল ছাত্রলীগ। আমরা এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার চাই।
আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদ সালাউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ১৯৯৬ সালে শিবির চেষ্টা করেছিল আন্দোলন করে কোটা পদ্ধতি বাতিল করতে, এরপর আত্মপ্রকাশ করে ২০১৮ সালে। এবারও তারা কোটা আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আন্দোলন করছে। শিবির টার্গেট করে উসকানি দিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নিয়ে হত্যা করেছে। চট্টগ্রামের মুরাদপুরে ছাত্রলীগ কর্মীদের ভবন থেকে ছুড়ে ফেলে হত্যা করেছে। সবকিছুর পেছনে একটা সংগঠন-শিবির।
আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মেহেদী হাসান বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের সাইকোলজি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি। আন্দোলনের নামে যারা রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভি পুড়িয়ে দেয়, মেট্রোরেলে আগুন দেয় এরা কারা। শিবিরের ঢাকা জেলার সাধারণ সম্পাদক সিয়াম বার্তা দিচ্ছে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রহিমা খাতুন মুক্তা বলেন, ১৫ জুলাই যেদিন আক্রমণ শুরু হলো সেদিনের কথা বলবো, আমি যে হলের আবাসিক শিক্ষক সেখানে ৩ হাজারের অধিক ছাত্রী। আমি ত্রিশ জনকেও আহত পাইনি। বিভাগে দুজন ছাত্রী আহত হয়েছে। তাহলে এত আহত কোথায় পাচ্ছে এরা? এখন, সাধারণ বলে আর কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। কিছু মায়েরা তাদের বাচ্চাদের নিয়ে আন্দোলনে এসেছে, এরা কারা? আন্দোলনের কতগুলো ছবি দেখে মনে হয়েছে, আন্দোলনের কোনো লক্ষ্য নেই, জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনের লক্ষ্য হতে পারে না।
ছাত্রলীগের স্কুল ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক রাজীব আহমেদ বলেন, ১৬ তারিখ ছাত্রলীগের শান্তি সমাবেশ ছিল রাজু ভাস্কর্যে। আর বৈষম্যবিরোধীরা ছিল শহিদ মিনারে। ওই দিন ওখানে তাদের সাথে নিষিদ্ধ ছাত্রসংগঠন মিশে যায়। উসকানি দিয়ে মাইকিং করে। পরদিন সকালে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমরাসহ অনেক সাধারণ শিক্ষার্থীসহ হল থেকে বেরিয়ে যাই। এরপর তারা ছাত্রলীগে নেতা-কর্মীদের রুমে রুমে তাণ্ডব চালায়। ছাত্রলীগ তো কোনো নিষিদ্ধ সংগঠন নয়, তাহলে এত আক্রোশ কেন? ছাত্রলীগের উপ স্কুল সম্পাদক তানজিম উল আলমকে চারতলা থেকে ওরা নিচে ফেলে দিল। ছাত্রলীগের প্রতি এরকম অবিচার কেন?
গৌরব ’৭১ এর সভাপতি এস এম মনিরুল ইসলাম মনি বলেন, দেশে যে নৈরাজ্য ঘটে গেছে এর ফলে মানুষ দুঃসহ জীবনযাপন করছে। এসব কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানাই। গৌরব ’৭১ সবসময় নৈরাজ্য নাশকতার বিরুদ্ধে। এর আগেও আমরা মাঠে থেকেছি। সরকারের কাছে দাবি, যারা দুষ্কৃতকারী তাদের চিহ্নিত করে যাতে বিচারের আওতায় আনা হয়।
গৌরব ’৭১ এর সাধারণ সম্পাদক এফ এম শাহীন বলেন, আন্দোলনে পেছনে থেকে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি তাদের অশুভ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য ছাত্রদের সামনে রেখেছে। যার ফলে আজ মায়েদের কান্না শুনতে পাচ্ছি। যারা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সুষ্ঠু তদন্ত করে তাদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানাই।
মুক্ত আলোচনায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিবার্তা২৪ডটনেটের সম্পাদক বাণী ইয়াসমিন হাসি, গৌরব ’৭১ এর সহ-সভাপতি হাবিবুর রহমান রোমেল, সাংগঠনিক সম্পাদক রবিউল ইসলাম রূপম, সাবেক ছাত্রনেতা জসিম উদ্দিন ভূইয়া, ব্যারিস্টার গৌরব চাকী প্রমুখ।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত