বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত বা এসএমই খাতের সম্ভাবনা এখন দেশের উন্নয়ননীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিশ্ব এমএসএমই দিবস উপলক্ষে এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন মো. মুসফিকুর রহমান এ প্রতিবেদকের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেন খাতটির লক্ষ্য, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে। তিনি বলেন, ‘আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে জাতীয় অর্থনীতিতে এসএমই খাতের সর্বোচ্চ অবদান নিশ্চিত করা। শিল্প, সেবা ও কৃষি খাত মিলিয়ে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ জিডিপি এসএমই খাত থেকে অর্জনের টার্গেট নেওয়া যেতে পারে, যেখানে শুধু সিএমএসএমই খাতের অবদানই হবে ৩৫ শতাংশ।’ তিনি উল্লেখ করেন, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলোর অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। ‘বাংলাদেশের শিল্প কাঠামো আসলে একটি পিরামিডের মতো নিচে মাইক্রো ও ক্ষুদ্র ব্যবসা, মাঝখানে মাঝারি, আর ওপরে বড় শিল্প। কিন্তু বাস্তবে অনানুষ্ঠানিক খাত এখনো অনেক বড় অংশজুড়ে আছে। এ খাতকে আনুষ্ঠানিক কাঠামোয় নিয়ে আসাই এখন আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ,’ বলেন তিনি। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যেন কেবল রেডিওর মতো হয়ে না যাই, শুধু প্রচার করি, কিন্তু বাস্তবে উদ্যোক্তাদের পাশে না থাকি। আমাদের ধাপে ধাপে কাজ করতে হবে- দক্ষতা উন্নয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলে অন্তর্ভুক্তি ও আনুষ্ঠানিকীকরণ। মুসফিকুর রহমান বলেন, ‘আমাদের প্রোডাকটিভিটি বা উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে হবে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ানের মতো দেশে ছোট ছোট ব্যবসাও আধা-স্বয়ংক্রিয় বা পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে চলে, ফলে খরচ কমে, দক্ষতা বাড়ে। আমাদের এখানেও আধা-স্বয়ংক্রিয়তা ও প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকে জোর দিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘একদিকে আমাদের স্থানীয় বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে হবে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ ও টিকে থাকার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। এ লক্ষ্যে আমরা এখন পর্যন্ত ১১টি জাতীয়, ৯৩টি বিভাগীয় বা আঞ্চলিক এসএমই পণ্য মেলা আয়োজনের পাশাপাশি কয়েক শ উদ্যোক্তাকে বিদেশের বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহণে সহায়তা করেছি। ৫৭ জন উদ্যোক্তাকে জাতীয় এসএমই উদ্যোক্তা পুরস্কার প্রদান করেছি।’ ‘নারী উদ্যোক্তাদের অর্থায়নে প্রবেশ এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক সময় ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যথেষ্ট নমনীয়তা দেখায় না,’ উল্লেখ করেন মুসফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এসএমই উদ্যোক্তাদের ঋণ পরিশোধের হার ৯৯ শতাংশের মতো, যেখানে বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ডিফল্ট রেট ১৯ শতাংশ পর্যন্ত। ফলে প্রকৃত উদ্যোক্তাদের সহায়তা করলে, তারা যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ঋণ পরিশোধ করেন।’ তিনি বলেন, ‘সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখলে ঝুঁকি বাড়ে। আমাদের পোর্টফোলিও ডাইভারসিফাই করতে হবে। ছোট উদ্যোক্তাদের একটা বড় অংশ ইতোমধ্যেই প্রমাণ করেছে যে, তারা দায়িত্বশীল এবং ঋণ ফেরত দিতে সক্ষম। সুতরাং এ খাতে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে।’ মুসফিকুর রহমান বলেন, ‘ই-কমার্স ও অনলাইন ব্যবসা হবে আগামী দিনের সম্ভাবনাময় খাত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অনেক উদ্যোক্তার ডিজিটাল দক্ষতা নেই। সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন মার্কেটিং, ডিজিটাল পেমেন্ট সবখানেই ঘাটতি। আমাদের পাঠ্যভিত্তিক ট্রেনিং নয়, বাস্তবভিত্তিক ডিজিটাল স্কিল উন্নয়ন করতে হবে, যাতে তারা বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারে।’ বিশ্ব এসএমই দিবস উপলক্ষে এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসনের এ বক্তব্য স্পষ্টভাবে তুলে ধরছে, এসএমই খাত শুধু একটি খাত নয়, এটি হতে পারে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের স্তম্ভ। সঠিক নীতি, সময়োপযোগী প্রযুক্তি, দক্ষতা উন্নয়ন ও অর্থায়নের মাধ্যমে এ খাতকে আরও এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। সিএমএসএমই খাতের উন্নয়নে এসএমই নীতিমালা ২০১৯-এর মেয়াদ শেষ হওয়ায় এসএমই ফাউন্ডেশনের সহায়তায় এসএমই নীতিমালা-২০২৫ প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। আমাদের আশা, এ নীতিমালা বাস্তবায়নে সরকার এসএমই ফাউন্ডেশনের অনুকূলে নিয়মিত অর্থ বরাদ্দ দেবে।